বিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছে, তখন ইলেকট্রিক যানবাহনের (ইভি) চাহিদা অভাবনীয় হারে বাড়ছে। কিন্তু এসব গাড়ির প্রাণযন্ত্র-ব্যাটারির জন্য প্রয়োজন হয় কিছু নির্দিষ্ট ধাতু, বিশেষত কোবাল্ট ও নিকেল, যেগুলো তুলনামূলকভাবে বিরল ও সংগ্রহে ব্যয়বহুল। সম্প্রতি জাপান এমনই এক বিশাল খনিজ সম্ভারের সন্ধান পেয়েছে-যা একই সঙ্গে সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, আবার এক নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনের কারণে সংশয়ের মুখে ফেলেছে।
সাগরতলের সোনার খনি
জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত প্রত্যন্ত দ্বীপ মিনামি-টোরি-শিমা। এই দ্বীপের সন্নিকটে গভীর সমুদ্রে আবিষ্কৃত হয়েছে আনুমানিক ২৬০০ কোটি ডলার মূল্যের বিরল ধাতুর খনি। এই খনিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কোবাল্ট ও নিকেল, যেগুলো ব্যবহার করা হয় বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির ক্যাথোড নির্মাণে।
জাপান সরকার ২০২৬ সালের মধ্যেই এখানে বৃহৎ আকারে খনন শুরু করতে চেয়েছিল। প্রকৌশলীরাও ইতিমধ্যে একাধিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই এই পরিকল্পনা নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বৈপ্লবিক আবিষ্কার: ডিআরএক্স ক্যাথোড
কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে এক নতুন ধরনের ব্যাটারির ক্যাথোড উদ্ভাবন করেছেন, যেটি তৈরি হয়েছে ডিজঅর্ডারড রক-সল্ট (ডিআরএক্স) উপাদান থেকে। এই ব্যাটারির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো-এটি তৈরি করতে কোবাল্ট কিংবা নিকেলের প্রয়োজন নেই।
ডিআরএক্স ব্যাটারির মূল বৈশিষ্ট্যগুলো:
>> প্রচলিত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় বেশি শক্তি ঘনত্ব;
>> দীর্ঘস্থায়ী চার্জ ক্ষমতা;
>> উৎপাদনে কম খরচ;
>> পরিবেশের ওপর কম ক্ষতিকর প্রভাব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।
অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দোলাচল
এই নতুন উদ্ভাবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো-এটি বিরল ধাতুর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেবে। ফলে, মিনামি-টোরি-শিমার মতো সমুদ্রতলের খনিগুলো অর্থনৈতিকভাবে আর তেমন লাভজনক থাকবে না। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এতে জাপানের দীর্ঘমেয়াদি খনন পরিকল্পনাগুলো ধাক্কা খেতে পারে।
অন্যদিকে, পরিবেশবিদদের কাছে এটি এক স্বস্তির খবর। কারণ, গভীর সমুদ্র খনন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনে। মিনামি-টোরি-শিমার আশপাশে সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি ও অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা গত কয়েক বছরে উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। খনির কারণে সাগরতলের ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ছে।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
বর্তমানে জাপান প্রতিবছর ৩০ লাখ টনের বেশি ম্যাঙ্গানিজ উত্তোলন করে। ডিআরএক্স প্রযুক্তি আরও এগোলে এই ধাতুর প্রয়োজনীয়তাও কমে যেতে পারে। অনেক বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা ইতিমধ্যে কোবাল্টমুক্ত ও নিকেলবিহীন ব্যাটারি নকশা নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
এই প্রযুক্তি যদি বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী ব্যাটারি উৎপাদনে এক বিপ্লব ঘটে যেতে পারে-যেখানে ব্যয়বহুল ও পরিবেশবিনাশী খনি নয়, বরং সাশ্রয়ী ও টেকসই প্রযুক্তিই হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি।
ডিআরএক্স প্রযুক্তি শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, এটি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা-যেখানে পরিবেশ, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি একইসূত্রে গাঁথা। এখন দেখার বিষয়, এই সম্ভাবনাময় আবিষ্কার কত দ্রুত বাস্তব রূপ নেয় এবং বিশ্ব কীভাবে এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করে। সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে