বিশ্ব প্রযুক্তির দৌড়ে চীন এখন শুধু অংশগ্রহণকারী নয়, অনেকক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকও। মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের পথ তৈরি করছে। তারই সাম্প্রতিক একটি বড় উদাহরণ-হুয়াওয়ের নতুন ফোল্ডেবল ল্যাপটপ ‘মেট বুক ফোল্ড আলটিমেট’, যেটি এখন প্রযুক্তিপ্রেমীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

এই ল্যাপটপের বিশেষত্ব শুধু এর ডিজাইন বা ফিচারেই সীমাবদ্ধ নয়-বরং এতে ব্যবহার করা হয়েছে হুয়াওয়ের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম হারমোনি ওএস ৫, যা উইন্ডোজের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।

কেন আলোচনায় হুয়াওয়ের এই ল্যাপটপ?
প্রযুক্তি বাজারে প্রতিদিনই নতুন কিছু আসে, কিন্তু হুয়াওয়ের এই ল্যাপটপ আলোচনায় এসেছে কয়েকটি বিশেষ কারণে:

 অভিনব ডিজাইন ও পাতলা গঠন
‘মেট বুক ফোল্ড আলটিমেট’ এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে পাতলা ফোল্ডেবল ল্যাপটপ হিসেবে পরিচিত।

>> খোলা অবস্থায় এর পুরুত্ব মাত্র ৭.৩ মিমি
>> ভাঁজ করা অবস্থায় ১৪.৯ মিমি
>> তুলনামূলকভাবে, লেনোভোর থিংক প্যাড এক্স১ ফোল্ড ল্যাপটপটির খোলা অবস্থায় পুরুত্ব ছিল ৮.৬ মিমি এবং ভাঁজ অবস্থায় ১৭.৪ মিমি।
>> এই ল্যাপটপের ফোল্ডিং স্ক্রিন, পাতলা বডি ও আধুনিক ডিজাইন একে করে তুলেছে আলাদা।

 প্রি-অর্ডারে রেকর্ড
ল্যাপটপটি বাজারে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি প্রি-অর্ডার পেয়েছে-শুধু চীনের বাজারেই। এই চাহিদা প্রমাণ করে, মানুষ এখন নতুন কিছু চায়, যা পশ্চিমা প্রযুক্তির বিকল্প হতে পারে।

হারমোনি ওএস ৫: চীনের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম
হুয়াওয়ের নতুন ল্যাপটপে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের তৈরি হারমোনি ওএস ৫। এটি শুধুমাত্র একটি অপারেটিং সিস্টেম নয়, বরং মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ও গুগল অ্যান্ড্রয়েডের বিকল্প হিসেবে চীনের প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতার প্রতীক।

 কেন হারমোনি ওএস গুরুত্বপূর্ণ?
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ও মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ ব্যবহারে বাধা তৈরি হয়। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হুয়াওয়ে নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরির দিকে এগিয়ে যায়। এখন হুয়াওয়ের ডিভাইসগুলো শুধু নিজস্ব চিপই নয়, নিজস্ব সফটওয়্যারও ব্যবহার করছে। এটিই প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথে বড় ধাপ।

চীনের লক্ষ্য: নিজের প্রযুক্তিতে নিজের ভবিষ্যৎ গড়া
চীনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল সিসিটিভি-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুয়াওয়ের হারমোনি ওএস চালিত ল্যাপটপ দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়নে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি ও সামরিক প্রতিষ্ঠানে উইন্ডোজের বিকল্প হিসেবে এই সিস্টেম দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

এছাড়া চীন সরকারি অফিসে অ্যাপল, উইন্ডোজ এবং ইন্টেল-ভিত্তিক কম্পিউটার ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করছে। পরিবর্তে স্থানীয় প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করছে।

দেশীয় চিপ উৎপাদনে বড় বিনিয়োগ
শুধু সফটওয়্যার নয়, চীন এখন নিজস্ব চিপসেট উৎপাদনেও বিশাল উদ্যোগ নিচ্ছে। ২০২৩ সালে তারা ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে 'Big Fund 2.0' নামে একটি প্রকল্পে। এই ফান্ডের লক্ষ্য হলো চীনের চিপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান SMIC-কে আরও শক্তিশালী করা। চীনের এই ধরণের পদক্ষেপ প্রমাণ করে, তারা কেবল আমদানিনির্ভর নয়, বরং রপ্তানিযোগ্য প্রযুক্তি তৈরি করতেই আগ্রহী।

আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের সম্ভাবনা
বর্তমানে হুয়াওয়ের এই ল্যাপটপ শুধুমাত্র চীনের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এটি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ করতে পারে।

বিশেষ করে
>> আফ্রিকা
>>দক্ষিণ আমেরিকা
>>দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

এই অঞ্চলগুলোতে মার্কিন প্রযুক্তির প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম এবং চীনা প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ছে।

নতুন যুগের বার্তা দিচ্ছে হুয়াওয়ে
হুয়াওয়ের মেট বুক ফোল্ড আলটিমেট ল্যাপটপ শুধু একটি নতুন প্রযুক্তি নয়, বরং এটি একটি বার্তা-বিশ্ব প্রযুক্তিতে চীন এখন নিজের অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করছে। নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম, নিজস্ব চিপ এবং বিশ্বমানের ডিজাইন-সব মিলিয়ে এটি এক নতুন যুগের সূচনা।

এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে এই সাহসী পদক্ষেপ কতটা গ্রহণযোগ্যতা পায়। সূত্র: হুয়াওয়ে সেন্ট্রাল