উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রত্যেক মানুষের জীবনে স্বপ্ন থাকে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাড়ি দিতে হয় একটা দীর্ঘ পথ। সেই পথে থাকে নানা বাধা-বিপত্তি, চ্যালেঞ্জ। যার লক্ষ্য স্থির থাকে, একদিন তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। এমনই একজন স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তা এস এম নাজমুল হাসান। ছাত্রজীবনে স্বপ্ন দেখেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করবেন। ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। চাকরিও করেছেন। পরে জীবনবাস্তবতার কারণে স্বপ্ন দেখেছেন ব্যবসা করবেন। আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। তার কোম্পানির তৈরি সিমলেক্স ভিপিএন (Symlex VPN) সফলভাবে সার্ভিস দেয়ার জন্য এবার বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ড ২০২২ এ বিজনেস সিকিউরিটি সলুশ্যন্স ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
বলছিলাম আইটি ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি কল্পলোক লিমিটেডের (Kolpolok Limited) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম নাজমুল হাসানের কথা।
যশোর সদরে জন্ম এস এম নাজমুল হাসানের। বাবা এস এম কাইয়ুম ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানবিদ। এখন অবসরে। মা নুরজাহান বেগম গৃহিনী। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল বড়। মেঝো ভাই এস এম এনামুল হাসান ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স পাস করে আমেরিকা যান। সেখানে মাস্টার্স শেষ করে জব করছেন। ছোট ভাই এস এম ইমামুল হাসান ইউআইইউ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনার্স পাস করে তার কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন।
নাজমুল ২০০৭ সালে চুয়েট থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ঢাকায় আসেন। চাকরি নামের সোনার হরিণের জন্য অনেক চেষ্টা করেন। সিজিপিএ খুবই কম থাকায় কোথাও থেকে ইন্টারভিউয়ের কল পাচ্ছিলেন না। হতাশা এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, মাত্র তিন হাজার টাকায় হাইসফ্ট নামের একটি কোম্পানিতে জয়েন করেন অন সাইট সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। যদিও একদিন কাজ করেই বুঝতে পারেন সেটা তার ক্যারিয়ার প্ল্যানের সাথে সাংঘর্ষিক। পরের দিন সিদ্ধান্ত নেন চাকরিটা করবেন না। আবার চাকরি খোঁজা শুরু করেন। তিন মাস বেকার থাকার পর আর অ্যান্ড ডি এপ্লিকেশন নামের কোম্পানিতে মোবাইল এপ্লিকেশন (J2ME) ডেভেলপার হিসাবে জয়েন করেন ১০ হাজার টাকা বেতনে। পরবর্তীতে কাজ করেন সিম্বিয়ান সি++ (Symbian C++) এ। অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে তিন মাস পর বেতন ডাবল হয়ে যায়। ২০০৯ এ বিয়ে করেন চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে অনার্স অধ্যয়নরত ফারজানা কাওসারকে।
বিয়ের কয়েক মাস পর প্রথম জব ছেড়ে দেন। জি আর ই প্রিপারেশন নেবার জন্য। লক্ষ্য আমেরিকা গিয়ে মাস্টার্স করবেন। কিন্ত কিছুদিনের মধ্যেই খুব ভালো বেতনে জবের অফার পান আগের কোম্পানির কলিগের মাধ্যমে আইবিএসএস নামক একটি কোম্পানিতে। পরিকল্পনাতে কিছু পরিবর্তন আনেন। ঠিক করেন জব করতে করতেই জি আর ই প্রিপারেশন নেবেন। যেটা কিছুদিন চালিয়ে গেলেও পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর মাঝে জীবনসঙ্গিনীর সাথে সংসার শুরু করেন।
তিন বছরের কিছু বেশি সময় জব করেছেন। এর মাঝেই গ্রামীণফোনের প্রাইমারি আইপিও পান লটারিতে। এর পরে সেকেন্ডারি মার্কেটে ২ লাখ টাকা ইনভেস্টের মাধ্যমে ব্যবসার শুরু। সেকেন্ডারি মার্কেটে ইনভেস্টের টাকাটা আসে ব্যাংক লোন থেকে। যেটা নিয়েছিলেন সংসার শুরু আগে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। পরে বিয়ের অনুষ্ঠানের টাকা অন্যভাবে ম্যানেজ করেন এবং পুরো টাকাটাই শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করেন। মূলত মেজো ভাই অভির উৎসাহের কারণেই শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করেন এবং তিনি মনে করেন সেখান থেকেই ব্যবসার প্রতি তার আগ্রহের শুরু। শেয়ার মার্কেটের নেশা এতটাই প্রকট ছিল যে এক পর্যায়ে দুই ভাই প্ল্যান করেছিলেন বাবার পেনশনের টাকাটা মার্কেটে ইনভেস্ট করা যায় কিনা। সেই ‘দুর্ভাগ্য’ আর হয়নি। ২০১০-১১ এর শেয়ার মার্কেট ধসের সাথে সাথে প্রথম ব্যবসার পরিসমাপ্তি ঘটে। বেশিরভাগ টাকা লস হয়।
নাজমুলের দ্বিতীয় ব্যবসা ছিল ফরচুন ইঞ্জিনিয়ারিং পাইলিং বিজনেস। ৬ জন পার্টনার। ২ টা ওয়ার্ক অর্ডার পান দ্রুত। কিন্তু ৩ থেকে ৪ মাসের মাথায় ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হন। এবারো লস। এর কিছুদিনের মধ্যে জব ছেড়ে একজন ইন্ডিয়ান পার্টনারের সাথে ভক্সভ্যালে টেকনোলজিস নামের সফটওয়্যার কোম্পানি দেন। তখন সিম্বিয়ান সফ্টফোনের প্রচুর চাহিদা ছিল। অফিস ছিল হায়দ্রাবাদ। ২০১১-১২ বেশ ভালো ব্যবসা করে ভক্সভ্যালে টেকনোলজিস। এরপর তিনি কিছু সমস্যার কারণে ভক্সভ্যালেতে পার্টনারশিপের সমাপ্তি ঘটান। ভার্সিটির বন্ধুর সাথে শুরু করেন সফটওয়্যার কোম্পানি স্পাইনিটেল প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত বেশ ব্যবসা সফল ছিল কোম্পানিটি। এর মাঝে ২০১৪ তে আল সাহের বিল্ডিং কনট্রাকটিং এল এল সি নামে পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করেন ইউএই-তে। ২০১৫ সালে একটি রেস্টুরেন্ট দেন চিটাগংয়ে যেটি এক বছর পরে বন্ধ করে দিতে হয় পর্যাপ্ত লাভ না হওয়াতে। শুরুর তিন বছর পর স্পাইনিটেল বন্ধ হয়ে যায়। তখন ব্যবসা লসের দিকে যেতে থাকলো।
থেমে নেই স্বপ্নবাজ এই উদ্যোক্তা। ২০১৬ সালে একক উদ্যোগে শুরু করেন সফটওয়্যার কোম্পানী কল্পলোক লিমিটেড যা প্রকৃত লাভের মুখ দেখে ২০১৯ সালে এসে সিমলেক্স ভিপিএন (Symlex VPN) প্রোডাক্ট এর মাধ্যমে। সফটওয়্যারটির মূল কারিগর ছিলেন রিয়াজ হাসান। এছাড়া টিম হিসাবে শুরুতে মারুফ হোসেন, সামুয়েল আমিন, আহমেদ রেজা শামীম, শফিউল গনি জুয়েল এবং এস এম ইমামুল হাসান ইমুর অবদান ছিল অপরিসীম। টিম মেম্বার প্রায় ৩৫ জন এবং প্রত্যেকের নিরলস পরিশ্রমের কারণে সিমলেক্স ভিপিএন আজ ৬ মিলিয়ন + সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করতে পেরেছে। একটিভ সাবস্ক্রাইবার এখন প্রায় ২ লক্ষ। যা ২০২১ এবং ২০২২ সালের শুরুতে ৩ লক্ষ পর্যন্ত উঠেছিল।
সিমলেক্স ভিপিএন যেটি এবারে বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডে বিজনেস সিকিউরিটি সলিউশন্স ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘অস্কার’ খ্যাত অ্যাপিকটা অ্যাওয়ার্ড আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্যও এটি নির্বাচিত হয়েছে। এর শুরুটা হয় ২০১৮ সালে। একজন তুর্কির কাস্টমারের মাধ্যমে। তিনি সিমলেক্স ভিপিএন-এর একজন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। তাদের ইনহাউজ ভিপিএন অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতে গিয়ে কল্পলোকের সিটিও রিয়াজ হাসান মনে করে এটিকে আমরা কাস্টমাইজ করে গ্লোবালি সার্ভিস দিতে পারি। কল্পলোকের বিডিএম মারুফ হোসেন মার্কেট এনালাইসিস করে পজিটিভ ফিডব্যাক দেয়।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে ১ বিলিয়নের অধিক মানুষ কখনো না কখনো ভিপিএন ব্যব্যহার করেছে। ইন্টারনেট ইউজারের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইন এ নিরাপত্তা ঝুঁকি। পাবলিক ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে। তাই বাড়ছে ভিপিএন এর চাহিদা। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ভিপিএন-এর মার্কেট ৭৪ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। সিমলেক্স ভিপিএন ( Symlex VPN)এখন পর্যন্ত ৬ মিলিয়ন এর অধিক বার সাবস্ক্রাইব করা হয়েছে। ৯৭% অপারেটিং সিস্টেমে চলছে সিমলেক্স ভিপিএন।
কল্পলোক লিমিটেড (Kolpolok Limited) মূলত আউটসোর্সিং কোম্পানি হিসাবে যাত্রা শুরু করে। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে Kolpolok Limited একটি টপ রেটেড কোম্পানি এবং তাদের জব সাকসেস রেট শতভাগ। কাস্টমারের ফিডব্যাক খুবই ভালো। তাদের বেশিরভাগ কাস্টোমারই পুনরায় কার্যাদেশ দেয়। একই রকম ফিডব্যাক সিমলেক্স ভিপিএন সার্ভিসেও। শতকরা ৮০ ভাগের বেশি কাস্টমার পুনরায় সার্ভিস নিয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানের নাম কল্পলোক রাখার পেছনের কারণ বলতে গিয়ে নাজমুল বলেন, কল্পলোক হবে এমন একটা ড্রিম কোম্পানি যেখানে কর্মীরা কাজ করার সময় ফিল করবে যে, আমি একটা কল্পনার রাজ্যে বা ড্রিম কোম্পানিতে কাজ করছি। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ থাকবে স্বপ্নের মত। আর অন্যদিকে যেসব ক্লায়েন্ট এখান থেকে কাজ সির্ভিস নেবে তারাও যেন ফিল করে যে, আমার ড্রিম প্রোডাক্টটি এখান থেকে ডেভলপ করে নিচ্ছি। এই দুটি ভাবনা থেকেই কোম্পানির নাম রেখেছি ‘কল্পলোক’।
চাকরির জীবনে যা কিছুর অভাব বোধ করেছেন বা ভেবেছেন এমনটা হলে ভালো হতো! তার সবকিছুর সন্নিবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেন কল্পলোকে। অবশ্য এর আগেও ভক্সভ্যালে এবং স্পাইনিটেল দুই জায়গাতেই একই কাজ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। যদিও সবকিছু অর্জন থেকে নিজেদেরকে অনেক দূরেই মনে করেন। ১০০০ লোকের কর্মসংস্থান করতে চান তিনি। কিন্তু বিশ্বাস করেন একদিন তা অর্জন করা সম্ভব হবে। কোম্পানির টিম মেম্বাররাই তা অর্জন করতে সবথেকে বেশি ভূমিকা রাখবে।
নিজের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিয়েটাকেই মনে করেন নাজমুল হাসান। ক্যারিয়ারের শুরুতে বিয়ে, বাড়ির বড় ছেলে, বাবার রিটায়ারমেন্ট সবকিছু মিলিয়ে যে চাপ ছিল তা ওভারকাম করতে গিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছেন বলে মনে করেন তিনি। এর পেছনে মূল ভূমিকা ছিল বাবা মায়ের দোয়া এবং জীবন সঙ্গিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা। যদিও এখনকার জীবনের লক্ষ্য থেকে তিনি অনেক দূরে বলেই মনে করেন। মা বাবার সেবা করা, ১০০ টি দেশ ভ্রমণ করা, ১০ হাজার বইয়ের লাইব্রেরি করা তার ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্য।
নাজমুল হাসান মনে করেন জীবনে উন্নতি করতে হলে কখনো না কখনো কঠোর পরিশ্রম করতেই হবে। আর ধারাবাহিকভাবে উন্নতি ধরে রাখতে হলে পরিশ্রমও ধারাবাহিকভাবে করতে হবে। পরিশ্রমের সাথে উপস্থিত বুদ্ধি, চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা এবং অন্তরের উপলব্ধির সঠিক প্রয়োগেরও দরকার আছে। বিপদ দেখলে যেমন থেমে যাওয়া যাবে না, তেমন কখন থামতে হবে তা বুঝতে পারাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।