হিমেল রোজারিও
পরিবারের বড় ছেলে নির্মল (ছদ্মনাম)। ঢাকা থেকে ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে পাশের গ্রামের কিশোরী সুলেখার সাথে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পরে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয়। নির্মল প্রায়ই প্রতি মাসেই বাড়ি চলে যায় সুলেখার সাথে দেখা করে। পারিবারিকভাবে ছয় মাসের মধ্যে এনগেজমেন্ট এবং নাম লেখার কাজ সম্পন্ন হয়। অবশেষে ডিসেম্বর মাসে বিয়েও হয়ে যায়। বাড়ির প্রথম বিয়ে তাই প্রায় সাত লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছে।
নির্মল পেশায় একজন শিক্ষক। বিয়ের পর হতে প্রতিমাসে দুইবার করে নির্মল বাড়ি আসে। বিয়ের পর থেকে সমাজের মানুষ একটু বেশি প্রধান্য দিয়ে মদের আসরে আমন্ত্রণ করে নির্মলকে। নির্মল এই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে পারে না। অপর দিকে নব-বিবাহিত স্ত্রী আশায় থাকে কখন বাড়ি আসবে এবং একান্তে দুইজন সময় কাটাবে। স্ত্রীর অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হয় না। রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। নির্মল বাড়ি এসে আর স্ত্রীর সাথে ভাত খাওয়ারও সময় না। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে স্ত্রীর সাথে ভালো করে কথাও বলতে পারে না। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকা চলে আসে নির্মল।
এভাবেই চলতে থাকে ছয় মাস। ছয় মাস পরে একদিন নির্মলের স্ত্রী সুলেখা (ছদ্মনাম) বাপের বাড়ি যাবার বায়না ধরে। সুলেখা বাবার বাড়ি যাবার পরে সে আর ফিরে আসতে চায় না। যদিও তাদের বিয়েটা ছিল প্রেমের। অনেকটাই আবেগ মিশ্রিত। সুলেখা সংসার কি তা খুব ভালোমতো বোঝে না। নির্মলের বাবা-মা বাড়িতে থাকলেও সুলেখার কাজের ভুল ধরতে সর্বদা ব্যস্ত। কখনো পিতৃ-মাতৃ সুলভ ব্যবহার করে সংশোধনের চিন্তা করেনি নির্মলের বাবা-মা।
>> এই লেখকের আরো লেখা পড়ুন: শেষ ইচ্ছা
সুলেখা আর ফিরে না আসায় নির্মলের স্বীকারোক্তি হলো যে, স্ত্রীকে যতটুকু সময় দেওয়ার কথা সেই সময়টুকু দেয়নি। সারা দিনে কর্মব্যস্ততার কারণে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি কেমন আছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে কিনা। স্ত্রীর ভালো লাগা না লাগা এই নিয়ে কখনোই জিজ্ঞাসা করেনি নির্মল।
স্বাভাবিকভাবে বর্তমান যুগের একটি কিশোরী মেয়ে সংসার নিয়ে গভীর চিন্তায় প্রবেশ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, একটি নতুন বাড়িতে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার মনোভাব সুলেখার মধ্যে হয়ে উঠেনি। তৃতীয়ত, স্বামী বাড়িতে থাকে না। সারা দিনে ফোনে দু-একবার কথা হয়। স্বামী বাড়িতে আসলে খুব বেশি সময় পায় না একসঙ্গে কাটানোর।
জোনাস-সাগরিকা দাম্পত্য জীবনের ৩৯ বছর অতিবাহিত করেছেন এক ছাদের নিচে। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ১০বছর। তারপরেও ছোট ছোট ত্যাগস্বীকার, সততা, সম্মান প্রদর্শন ও বিশ্বস্ততার মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদে সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন।
জোনাস-সাগরিকা দম্পতির কাছে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ জানতে চাইলে জোনাস বলেন, এই যুগে বিবাহের পরে সস্পর্ক ধরে রাখা খুব কঠিন। সংসার করতে গেলে ছোট-খাটো ঝগড়া হয়ে থাকে। যেসকল পরিবারে বিচ্ছেদ ঘটেছে তাদের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে কারণগুলো ছিল খুবই সূক্ষ্ম। সামান্য কারণগুলো ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করে। যদি সামান্য বিষয় নিজেদের মধ্যে সমাধান করে ফেলে তাহলেই অনেক পরিবার বেঁচে যায় বিচ্ছেদের হাত থেকে। অনেক সময় দেখা যায় একে অন্যর প্রতি ত্যাগস্বীকারের মনোভাব কম। ছোট ছোট ত্যাগস্বীকারের জন্যই আমাদের দুই জনের বন্ধন টিকে রয়েছে আজ পর্যন্ত।
>> এই লেখকের আরো লেখা পড়ুন: সমবায় সমিতি-নির্বাচন ও খ্রিষ্টান সমাজ
সাগরিকা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর ভিন্নতার কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। পরিবারে অনেক সময় তৃতীয় পক্ষের প্রবেশের কারণেই সোনার সংসার ভেঙ্গে যায়। এছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বস্ততা না থাকলে একে অপরকে অযথা সন্দেহ করতে থাকলে সংসার ভেঙ্গে যায়, ছেলে-মেয়ের বয়সের ব্যবধান বেশি হলে, একে অন্যকে অযথা দোষারোপ করা, যথাযোগ্য সম্মান/মর্যদা না দেওয়ার কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। বর্তমানে যারা যেসকল দম্পত্তি চাকরি করে তারা অনেকেই ছুটির দিনে বাইরে ঘুরতে যেতে চায়। অনেক সময় স্বামী বিশ্রাম নিতে চায় স্ত্রী ঘুরতে যেতে চায় এই নিয়ে মনোমালিন্য হয়। এ থেকে অনেক সময় পরকীয়ার রূপ নেয়। তার পরেই হয় বিবাহবিচ্ছেদ।
জোনাস বলেন, বিয়ের পূর্বে দম্পতিরা যা আশা করে বিয়ের পরে তা পায় না। কাঙ্ক্ষিত বিষয়-বস্তু না পেলে একে অন্যের সাথে রাগারাগি করে (টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, ঢাকায় বসাবাস করা নিয়ে)। এই কারণে নতুন সংসারে ফাটল ধরে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের শারীরিক অক্ষমতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে থাকে। তবে বিবাহিত জীবন একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ যদি কেউ মোকাবেলা করতে না চায় তাহলে কখনোই সম্ভব নয় সুখী বিবাহিত জীবন গড়া।
সাগারিকা বলেন, বিয়ের দিন যে প্রতিজ্ঞা করা হয় সেই প্রতিজ্ঞাই হচ্ছে খ্রিষ্টীয় বিবাহের মূল ভিত্তি। দুইজনে প্রতিদিন বিশ্বাসভরা অন্তরে প্রতিজ্ঞা নবায়ন করা উচিত। এই প্রতিজ্ঞার মধ্যদিয়ে আমি থেকে আমরা হয়ে যাই এবং একে অন্যের জন্য নিজেকে বিসর্জন দেই। নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে একে অপরের সাথে সহভাগিতাই পারে একটি পবিত্র পবিবার হিসেবে গড়তে।
পরিবার হচ্ছে গৃহ মণ্ডলি। আমাদের সমাজে যদি পরিবারগুলো গঠন হওয়ার আগেই বিচ্ছেদ ঘটে, তাহলে ভালো পরিবার গঠন কখনোই সম্ভব নয়। ভালো পরিবার ব্যতীত সমাজ এবং মণ্ডলি পরিকল্পনাই করা যায় না। বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব আমাদের পরিবার ও সমাজ জীবনের উপর প্রকটভাবে প্রভাব ফেলছে। ছোট ছোট কারণে আজ নবগঠিত পরিবারগুলো হুমকির মুখে।
একে অন্যকে ভালো না লাগার কারণেই বিচ্ছেদ ঘটে থাকে। কিন্তু দেখা গেছে বতর্মানে বিচ্ছেদের দিকদিয়ে মেয়েরা অনেক বেশি এগিয়ে আছে। সেই ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েদের বিচ্ছেদের পর সমাজ কখনোই ভালো চোখে দেখ না। সুখের আশায় বিচ্ছেদ করে থাকে দম্পতিরা। পরবর্তীতে দেখা গেছে আবার নতুন করে বিয়ে করলেও সংসার দুই-তিন বছরের বেশি টিকে না। তখন তাদের জীবনের সুখের চেয়ে দুঃখের পাল্লাটি ভারি হয়ে যায়।
বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান শিকার হন সন্তানরা। তারা বেড়ে ওঠে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির’ সন্তান হিসেবে। যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তারা এক ধরনের ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে’ ভোগে। মনোচিকিৎসকরা মনে করেন, ‘সন্তানরা যদি বাবা-মায়ের স্বাভাবিক সঙ্গ এবং ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। তারা সমাজকে, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখে। তাদের মধ্যে জীবনবিমুখতা তৈরি হয় যা ভয়াবহ।
পারিবারিক ও মাণ্ডলিক চ্যালেঞ্জসমূহ
কাথলিক মণ্ডলিতে বিবাহ একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। পবিত্র বাইবেলে লেখা আছে ‘ঈশ্বর যা যুক্ত করেছেন মানুষ যেন তা বিচ্ছিন্ন না করে।’ কাথলিক মণ্ডলী বিবাহবিচ্ছেদ কখনোই সমর্থন করে না। কারণ একটি বিবাহবিচ্ছেদের কারণে প্রথমত দুটি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয়। যদি ছেলে-মেয়ে থাকে তারা মানসিকভাবে কষ্টে থাকে। বাবা-মায়ের শাসন ব্যতীত সন্তানেরা কখনো ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। কারণ নিজের জন্ম দেওয়া সন্তানের লালন-পালন অন্য কেউ দায়িত্ব ও গুরুত্বের সাথে পালন করতে পারে না। বিচ্ছেদকৃত পরিবারের সন্তানেরা মানসিকহীনমন্নতায় ভোগে বেশি। কৈশোরে এসে অন্য ধর্মের বন্ধুদের সাথে বেশি মেলামেশা করে। নিজের সমাজে অনেক সময় তাদেরকে নিচু করে দেখা হয়। খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। জীবনে বিভিন্ন সময় ছেলে-মেয়েরা ব্যর্থ হয়ে থাকে।
তখন বাবা-মা পাশে না থাকলে এই সামান্য ব্যর্থতা থেকে হতাশায় পরিণত হয়। হাতাশ এবং দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের নেশার আশ্রয় নেয়। নেশা যখন নিয়মিত করে তখন সে (ছেলে-মেয়ে) নেশাকে কাছের সঙ্গী করে থাকে। অনেক সময় নেশা করার প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না। নেশার অর্থের জন্য চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি করে থাকে। এই চুরি-ডাকাতির ফলে অন্য পরিবারও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যে সকল বিচ্ছেদকৃত ছেলে-মেয়েরা অনৈতিক জীবন যাপন করে বেড়ে উঠে তাদের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধ কাজ করে না। তারা যখন পরিবার গঠন কববে, কখনোই একটি ভালো পরিবার গঠন করতে পারবে না। কারণ ভালো এবং সুন্দর পরিবার সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। বিশেষ করে বিচ্ছেদকৃত পরিবারের সন্তানেরা অল্প বয়সে প্রেম করে অনেক সময় সমাজে এবং মল্ডলিতে নতুন সমস্যার জন্ম দেয়।
বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে ঢাকার সানিডেইল স্কুলের অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদ বলেন, মা-বাবার বনিবনা না হওয়া বা বিবাহবিচ্ছেদ সন্তানের জীবনে খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সন্তানের সামনে আপনারা যে ধরনের আচরণ করবেন, সন্তান আপনার অজান্তে তা শিখে ফেলবে। পরে আপনি যখন তাকে ভালো কিছু শেখাতে যাবেন, সে শিখবে না।
বিচ্ছেদকৃত দম্পতির বিচ্ছেদের পরে যদি তারা আবার নতুন করে মণ্ডলি বহির্ভূত পরিবার গঠন করে বা বিয়ে করে সেখানেও তৈরি কিছু সামাজিক সমস্যা। ছেলে যদি মণ্ডলির আইনের বাইরে গিয়ে বিবাহ করে, তখন সেই পরিবারকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সেই পরিবারের কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে না। সমাজে সেই পরিবারেকে একঘরে করে রাখা হয় এবং হেয়প্রতিপন্ন করা হয়ে থাকে। একটি বিচ্ছেদের কারণে প্রথমত পরিবার ধ্বংস হয়। তারপর একটি সমাজের মধ্যে এর প্রভাব বিস্তার করে এবং সেই প্রভাব সরাসরি মণ্ডলিতে পড়ে। কারণ আমরা খ্রিস্টভক্তরাই খ্রিস্টমণ্ডলির সদস্য।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণে স্বামী-স্ত্রী ক্ষণিকের জন্য লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি সন্তানেরা। সন্তানেরা বাবা-মা হারা হয়ে থাকে। পারিবারিক মূল্যেবোধ ও নৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। পিতা-মাতার আদর-ভালোবাসা থেকে বেশি বঞ্চিত হয়ে থাকে। পারিবারিক শাসন থেকেও বঞ্চিত হয়।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণসমূহ
যে সকল কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- বিবাহ বিচ্ছেদের পারিবারিক কারণ (শ্বশুর-শাশুরি, দেবর-ননদ, তৃতীয় পক্ষ), স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সমস্যা, স্বামী নেশা করে, পরকীয়া (স্বামী-স্ত্রী যে কেউ), গ্রহণ যোগ্যতার অভাব, ভুল বোঝাবুঝি, অল্পতে রেগে যাওয়া, অর্থের অভাব, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসক্ত, পরিবারের দায়িত্ব পালন না করা, পরিবারে সময় না দেওয় (স্বামী-স্ত্রী), অবহেলা করা, উচ্চ বিলাসী জীবন-যাপনের মনোভাবসহ আরো অনেক কারণ বিদ্যমান।
বয়সের পার্থক্যটা পাঁচ বছরে দাঁড়ালে ১৮ শতাংশ এবং ১০ বছর হলে ৩৯ শতাংশ দম্পতির বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানী জন গটম্যান বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে চারটি প্রধান কারণকে দায়ী করেছেন। যে দম্পতিদের মাঝে এই চারটি বিষয় উপস্থিত থাকে, তাদের বিচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক। সেগুলো হচ্ছে- ১। সঙ্গীকে ছোট করে দেখা,২। অবজ্ঞা করা, ৩। সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপারে লাগাতার সমালোচনা করা, ৪। দাম্পত্য জীবনের কোনো সংকটে বা কঠিন পরিস্থিতে নিজেকে সবসময় নির্যাতিত কিংবা ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করা, একে অন্যের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া।
‘যেসব দম্পতির বৈবাহিক জীবন অতিরিক্ত রোমান্টিকতা দিয়ে শুরু হয়, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেশি। কারণ, ওরকম রোমান্টিকতা ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য যে, যাদের দাম্পত্য জীবনের শুরুতে তুলনামূলক কম ‘হলিউড রোমান্স’ থাকে, তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক মজবুত হয়।’
বিবাহবিচ্ছেদের বর্তমান পরিসংখ্যান
২০১৫ সালে শুধু ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনেই বিচ্ছেদ কার্যকর হয়েছে মোট ৩ হাজার ৫৩০টি! বিবাহবিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে আছেন। বিচ্ছেদ কেন বাড়ছে? প্রশ্ন উঠছে এটা সচেতনতার ফল না কথিত আধুনিকতার প্রভাব। ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় একটি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুটি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় ২ হাজার ৩০৯টি, যার মধ্যে ১ হাজার ৬৯২টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তালাকের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৯টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক হয়েছে ১ হাজার ২০৮টি। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালাক দেয়া পুরুষ ৩০ শতাংশ, আর নারী ৭০ শতাংশ।
‘জাতীয় মহিলা পরিষদ’ নারীদের তালাকের ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো, যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর পরনারীতে আসক্তি। ‘পরনারী’ বা ‘পরপুরুষে’ আসক্তির অভিযোগ বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে। গত জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ফলাফলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, গত বছর ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রতি এক হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ১ দশমিক ৪টি তালাকের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে যা ছিল ১ দশমিক ৫। বর্তমানে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি তালাক হয় (২ দশমিক ৭)। আর সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে (দশমিক ৬)।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের মতামত ছাড়া কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে বেশি বয়সী লোকের সঙ্গেও অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে এ ধরনের বিয়েগুলো টিকছে না।
বিচ্ছেদ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সন্দেহ, যৌতুক দাবি, সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, স্বামী-স্ত্রীর জীবন-যাপনে অমিল, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে বিচ্ছেদের হার ছিল দশমিক ৬ জন, পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক ১ জন। বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন তাদের সংখ্যা বেশি (হাজারে এক দশমিক ৭ জন)। আর অশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৫। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের হার যেখানে হাজারে এক দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৮ জন।
দেখা যায় যে, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আবেদন করছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, নৈতিক স্থলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজে এখন বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বিচ্ছেদের নোটিস পাঠানো হয়েছে ২৪ হাজার ৯১২টি। এর মধ্যে পুরুষের পাঠানো নোটিসের সংখ্যা আট হাজার ৯৬টি এবং নারীর ১৬ হাজার ৮১৬টি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের তথ্যে, ২০১৭ সালে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ১৩৮টি দম্পতির তালাক হয়। এর মধ্যে ৮৯ জন নারী বিচ্ছেদের আবেদন করেন। আর পুরুষদের মধ্যে বিচ্ছেদের আবেদন করেন ৪৯ জন। খুলনা মহানগরীতেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে খুলনা মহানগরীতে মোট বিচ্ছেদ হয়েছে ছয় হাজার ৫৪৭টি।
চট্টগ্রামেও বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের হিড়িক পড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যে, সেখানে এক হাজার ৫৭৯টি বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়। আর প্রতি মাসে গড়ে ৩৮৪টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে সেখানে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে বিচ্ছেদ ঘটছে ১৫টি আর প্রতি দুই ঘণ্টায় একটির বেশি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায়। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর আবেদনকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহীতে। প্রতি হাজারে সেখানে এক দশমিক ৯ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন।
বিবিএসের হিসাব মতে, রাজশাহীর পর পরই সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হচ্ছে খুলনায়। সেখানে প্রতি হাজারে এক দশমিক ৩ জন বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, ২০১৬-১৭ সালে মোট ৪৩৮ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। আর প্রতি মাসে গড়ে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে ২২ দম্পতি। গত এক বছরে ময়মনসিংহে আশঙ্কাজনকহারে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ সময় সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ হয় মোট চার হাজার ৮০৮টি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, একটি পরিবার ভেঙে গেলে শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সম্পর্কে ফাটল ধরে না, তাদের সন্তানদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। রাজধানী ঢাকার নিকাহ রেজিস্ট্রার জানান, ঢাকায় প্রতি বছরই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো: ১১ জুলাই ও ২৭ আগস্ট ২০১৮, ১০ আগস্ট ২০১৯। হারুন উর রশিদ স্বপন, ঢাকা। রোয়ার বাংলা: সায়েম সেমস, ১৭ নভেম্বর ২০১৯।
লেখক : গল্পকার, কবি ও সাংবাদিক, জাতীয় দৈনিক নতুন সময়।