উজ্জ্বল এ গমেজ
পড়ছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি তার নেশা। বর্তমান সময়ের সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন অসঙ্গতি, সামাজিক সচেতনতামূলক বিষয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়ে কবিতা লেখেন তিনি। ইংরেজি, বাংলা ও আরবিতে এসব কবিতা লেখেন। আর সেগুলো ভিডিওতে ধারণ করে অনলাইনে প্রকাশ করেন। সেই সাথে নিজের লেখা কবিতার সুর করে দেশে র্যাপ গানের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন তিনি। তিন বছর ধরে এ গান করে লাখো ভক্তের প্রশংসা কুড়িয়ে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই তরুণ শিল্পী।
এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন বাংলা র্যাপ সংগীতের প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বর, তরুণ কবি মাহমুদ হাসান তবীব। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সামাজিক সচেতনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক গান করে প্রশংসা কুড়িয়ে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।
তবীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্যে পড়ছেন। তবুও বাংলা ভাষায় প্রতিবাদী কবিতা লিখে, সুর করে নিজের কণ্ঠে গান করে লাখো ভক্তের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। সেই সাথে জয় করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয়। এর পেছনে রয়েছে আরো অনেক কাহিনী। সে গল্প জানতে যেতে হবে আরো অনেক পেছনে।
মাহমুদ হাসান তবীবের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা পেশায় সরকারি শিক্ষক। মা গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তাবীব দ্বিতীয়।
তাবীবের শৈশব ও কৈশোরের স্বর্ণালী দিনগুলো কাটে নিজের এলাকায়। মাদরাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে নিজেকে শিক্ষায় যোগ্য করে তুলতে ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য বিভাগে।
পড়ার বিষয় হিসেবে আরবিকে বেছে নেয়ার কারণ জানালেন তাবীব। তার ভাষ্য, বাবা ঢাবি থেকে একই বিভাগে একই বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স পাস করেছেন। বাবাই আমার অনুপ্রেরণা। তাছাড়া, আরবি সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার থেকে বাংলা ভাষার ভাণ্ডারকে যাতে আরো সমৃদ্ধ করতে এবং উভয়ের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারি তার জন্য পড়াশুনা করছি। আমাদের দেশের অনেক লেখক ইংরেজি সাহিত্য থেকে সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তবে আরবি সাহিত্য থেকে বাংলায় কাজ খুব কম রয়েছে।
লেখালেখির প্রতি তার নেশা ছোটবেলা থেকেই। সময়ের পালাবদলে ভার্সিটিতে এসে তাতে যোগ হয় নতুন পালক। চলমান সময়ের সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতি, অন্যায়, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের দুঃখ-কষ্ট তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। কলমের যাদুতে সেগুলি তুলে ধরতে থাকেন কবিতার ভাষায়। আবার কখনো বা তুলে ধরে নিজে স্ক্রিপ্ট লিখে ডকুমেন্টরি তৈরির মাধ্যমে। সেগুলো ইউটিউবে প্রকাশ করতে থাকেন। এভাবে প্রতিবাদের ভাষা ছড়িয়ে দিতে থাকেন ভার্চুয়াল দুনিয়ার সব শ্রেণির মানুষের কাছে।
কবিতা লিখে নিজে আবৃত্তি করে সেগুলো ইউটিউবে দিয়ে এবং নিজের ডকুমেন্টারির মাধ্যমে তেমন একটা মানুষের নজর কাড়তে পারছিলেন না তবীব। তবে লেখালেখি থামাননি। লিখে যেতে থাকেন। আর নতুন করে ভাবতে থাকেন কী নিয়ে কাজ করলে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেয়া যায়। মাথায় আসে এই শহরের অলি-গলি, ফুটপাথে থাকা অসহায় ছেলেদের জীবনের হাজারো আবদার, চাওয়া, না পাওয়া, দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনার কাহিনী নিয়ে গান করলে কেমন হয়। নিশ্চয় মন্দ হবে না। তখন মনে মনে খুঁজতে থাকেন পথশিশুদের।
সময়টা ছিল ২০১৯ সালের মাঝামাঝি। প্রতিদিনের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুল বিক্রি করছিল পথশিশু রানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তবীব। ফুল বিক্রি করতে করতে রানা তার কাছে ছুটে গিয়ে বাইকে চড়ার আবদার করে। দেখে বস্তির শিশু মনে হলেও খানিকটা আলাদা করা যায়। তার চোখে-মুখে চটপটে ভাব। অনেকটা কৌতূহলের বশেই তাকে বাইকে উঠিয়ে নেন তবীব। তারপর পথ চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করেন, তুই গান গাইতে পারিস? বাইকে বসেই রানা সেদিন গলা উঁচিয়ে তবীবকে শুনিয়েছিল একটা র্যাপ গানের কয়েকটা লাইন। রানার গানের সুর, গায়কি স্টাইল তবীবকে মুগ্ধ করে।
তবীব ছোট থেকেই হিপহপের ভক্ত ছিলেন। বাংলায় র্যাপ গান বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। ভিডিও গান বানানোর কথা ভাবতেন। কিন্তু বিষয় কী হবে? তবীব বলেন, কিছু দিন আগে রণবীর সিংহ অভিনীত বলিউড ছবি গালিবয় দেখেছিলাম। ওই সিনেমা দেখেই ঠিক করে ফেলি, ঢাকাইয়া গালিবয়দের জীবনকে নিয়েই র্যাপ গান বানাবো। আর সে রকম একটা সময়েই রানার সঙ্গে পরিচয়।
পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত র্যাপ গান চর্চা শুরু করেন তবীব। তার অনেক দিনের ইচ্ছা কোনো একজন পথশিশুকে দিয়ে তাদের কষ্টের গল্প তুলে ধরবেন। রানার কণ্ঠ শোনার পরই মনে হলো, ওকে দিয়েই ইচ্ছাটা পূরণ করা যায়। এরপর ওর পরিবারের গল্প শোনেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই গানটা লিখেও ফেলেন। কোথাও কখনো গান না শিখলেও তবীবের কাছে অল্প সময়ের মধ্যেই গানটি গলায় তুলে নেয় রানা।
র্যাপ গান বলতে এমসিং বোঝানো হয়ে থাকে, যা এমন এক ধরনের গায়কি, যাতে গানের কথা বলা হতে থাকে তাল ও ছন্দের মাধ্যমে যার সাথে থাকে নানা রকমের বিট। আধুনিক বিটে থাকে ড্রাম, সিন্থিসাইজার ও সরাসরি ব্যান্ড। যেন এখানেই মিলে গেল সব কিছু। যেন হাতের কাছেই পাওয়া গেল এমন কাউকে। যে তবীবের স্বপ্নটাকে বাস্তব করে দিতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তবীব রানাকে নিয়ে র্যাপ গান বানানোর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলেন। আর তাতেই বাজিমাত।
রানাকে পেয়ে ‘গালি বয়’দের জীবন আরও কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেলেন তবীব। তারপর তবীবের লেখা ও পরিচালনায় রানাকে নিয়ে তৈরি হলো ‘গালি বয়’। এই ভিডিওর তিনটি পর্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বর্তমান সময়ের সমাজব্যবস্থার ময়নাতদন্ত প্রকাশিত হয় তবীবের কবিতার ছন্দে ও গানের মন মাতানো সুরে। যার গানের প্রতিটি লাইন অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের কথা বলে। শহর-বন্দরের গলি, ফুটপাথে থাকা রানার মতো হাজার হাজার রানার জীবনকথা, চাওয়া, না পাওয়া, বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠেছে ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওতে। সমাজের অনেক রানার বঞ্চনার প্রতিচ্ছবি যেন ওঠে এসেছে।
রানাকে নিয়ে প্রথম গান ‘গাল্লিবয়’ প্রকাশ করেন তবীব। এরপর আসে ‘গাল্লিবয় পার্ট-টু’ ও ‘গাল্লিবয় পার্ট-থ্রি’। এবার সর্বশেষ এসেছে তাদের নতুন গান ‘হিপহপ পুলিশ’। প্রথম ভিডিওতে রানার সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি ‘গালি বয়’দের জীবনচিত্র তুলে ধরেছিলেন তবীব। দ্বিতীয় ভিডিওতে রানাদের সমস্যা নিয়ে একরাশ প্রশ্ন সমাজের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। শিশুদের শিক্ষা ও পুষ্টির মতো মৌলিক অধিকারের বিষয় নিয়ে সমাজের উদাসীনতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে তবীব-রানার ‘গালি বয়’।
তবীব বলেন, গালি বয়। মূল নাম রানা মৃধা। অনলাইনে ভাইরাল হওয়া দেশের র্যাপ গানের রাজপুত্র ১০ বছরের রানার পরিচিতি এখন একজন র্যাপ গায়ক হিসেবে। শুধু ঢাকাই নয়, ঢাকা ছাড়িয়ে দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে রানার নাম। কেবল দেশেই নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে রানা এখন দারুণ জনপ্রিয় ওপার বাংলাতেও। সেখানকার পত্র-পত্রিকাও রানাকে নিয়ে খবর ছাপছে। রানা এখন দেশ-বিদেশের জনপ্রিয় ক্ষুদে তারকা।
শুধু ভিডিও নয়, রানার জীবনের পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন তবীব ও তার বন্ধুরা। রানাকে দিয়ে গান গাইয়ে ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে সেখান থেকে আয় করে তার স্কুলের খরচ চালানো পরিকল্পনা করেন তারা। এখনও পর্যন্ত গালি বয় থেকে চার হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। তবীবের ভাষ্য, ইউটিউব চ্যানেল থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তার অর্ধেক দেয়া হবে রানাকে। সঙ্গে দশম শ্রেণি পর্যন্ত রানার স্কুলের ফি মেটানোর সমস্ত ব্যবস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো আমরা।
এক পা, দু’পা করে এখন তুমুল জনপ্রিয় গালিবয় রানা ও তবীব। টিএসসিতে ফুল বিক্রি করা রানা এখন স্কুলে পড়ে। আনকোরা গায়ক তবীবও বেশ পরিণত। মাত্র এক বছরের যাত্রায় তারা জায়গা করে নিয়েছেন দেশ-বিদেশের শ্রমিক আর দিনমজুরদের মনের মণিকোঠায়। সেই সাথে এই জুটি জয় করলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয়। তাদের প্রতিভার মূল্যায়নে উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন অত্যাধুনিক ভিডিও ক্যামেরা। শুধু তাই নয়, রানার পড়াশোনার খরচও বহন করার কথা জানিয়েছে সরকার।
তবীব শুধু সৃজনশীল গায়ক নন, তিনি একজন মেধাবী, প্রতিবাদী কবি, জীবন যুদ্ধের বিদ্রোহী সৈনিক, লেখক এবং কিশোর উদ্যোক্তা। তিনি কিশোরদের বাস্তবতার আলোকে সঠিক স্বপ্ন দেখান। সমাজের বাস্তব করুণ চিত্রগুলো তুলে ধরেছেন প্রতিটি গানের মাঝে। প্রতিটা গানে রয়েছে ক্ষুধার্ত ও অবহেলিত মানুষের কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পক্ষের কথা।
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা গলিবয় রানা ও তাবিব এক বছরের যাত্রায় পেয়েছেন লাখো মানুষের ভালোবাসা। অনেক তরুণের আইডল বনে যাওয়া তাবীব মাহমুদের ভিডিও ইতোমধ্যে ১০ লক্ষাধিক মানুষ দেখেছে।
‘আমি রানা গাল্লি বয়’ দিয়ে ইউটিউবে সারাদেশের তরুণ সমাজে ঝড় তোলা তবীব সময়ের সাথে সাথে বেশ কিছু গান রিলিজ দিয়েছেন। শুধু গানে সীমাবদ্ধ না থেকে অমর একুশে বই মেলা-২০২০ তে একটা কবিতার বই প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবী ছাত্র। জনপ্রিয় হিপহপ গানের শিল্পী ও প্রতিবাদী কবি তাবীব মাহমুদের বইয়ের নাম ‘কিছু বইয়ের নাম থাকে না’। ইউটিউবে একটি গানের মাধ্যমে তিনি বইটির প্রচার করেন। অমর একুশে বই মেলা-২০২১ তেও বইটি বেশ বিক্রি হয়। এবার বই মেলাতেও কবিতার বইটি বিক্রি করা হবে।
এছাড়াও তবীবের ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে সাধারণ জ্ঞানের একটা বই রয়েছে। বইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পথ সহজ করবে। অনলাইন প্লাটফর্ম রকমারি.কমে বইটি পাওয়া যাবে।
এভাবেই অসহায় সুবিধা বঞ্চিত সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা নিয়ে কবিতার ভাষা এবং গানের সুর ও ছন্দে মানুষের চেতনায় নতুন করে ইতিহাস লিখতে চান প্রতিবাদী এই কবি। সমাজের অসঙ্গতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা লিখে সেগুলি নিজের কণ্ঠের গায়কিতে অভিনবভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে মনে খুঁজে পান প্রশান্তি। আর এভাবে সুরের মূর্ছনায় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে চান অদম্য তরুণ এই শিল্পী। লেখালেখির নেশার সাথে এখন তার যোগ হয়েছে সুরের যাদুর নেশা। এটাকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার। খেটে খাওয়া অসহায় মানুষদের নিয়ে কাজের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকতে চান যুগের পর যুগ। সে লক্ষে ছুটে চলছেন অবিরাম। এর জন্য সকলের দোয়া চেয়েছেন তিনি।