বর্তমানে প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর একটি-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI (Artificial Intelligence)। দ্রুত পরিবর্তনশীল এই প্রযুক্তি যেমন আমাদের দৈনন্দিন কাজকে সহজ করে তুলছে, তেমনি এর প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রেও-সেটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক, উভয় দিক থেকেই।
মানুষ কি চাকরি হারাবে?
বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক সময়ের কর্মী ছাঁটাইয়ের বড় একটি কারণ হিসেবে এআইকে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব কাজ সহজ, পুনরাবৃত্তিমূলক বা রুটিনভিত্তিক, সেখানে এআই ব্যবহারের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান জনবল কমিয়ে দিচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অব জবস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রাহকসেবা, টেলিমার্কেটিং, অনুবাদ, প্রুফরিডিংসহ বেশ কিছু পেশার চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে পারে। কারণ এসব কাজে মানুষের তুলনায় এআই অনেক দ্রুত ও খরচসাশ্রয়ীভাবে কাজ করতে সক্ষম।
আছে আশার আলোও
তবে শুধু নেতিবাচক দিকেই নয়, এআই খুলে দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দরজাও। গবেষণা বলছে, এআই নতুন পেশার জন্ম দিচ্ছে, আবার পুরোনো কাজগুলোতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করছে।
মার্সারের লিসা লায়ন্স যেমন বলেছেন, “মানুষ আর এআই একসঙ্গে কাজ করবে-এটাই ভবিষ্যৎ।” একঘেয়ে কাজগুলো এআই করে দিলে কর্মীরা মনোযোগ দিতে পারবেন সৃজনশীল ও সিদ্ধান্তভিত্তিক কাজে, যা ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও চাকরি আনন্দময় করে তুলবে।
এআই পারবে না সব কিছু
এমন অনেক কাজ আছে যেখানে এখনও মানুষের বিকল্প এআই হতে পারছে না-যেমন ডাক্তার, নার্স, সার্জন, সমাজকর্মী, শিল্পী, কিংবা দক্ষ কারিগরদের কাজ।
কারণ এসব কাজের পেছনে থাকে মনোযোগ, সহানুভূতি, অভিজ্ঞতা ও মানবিক বোধ, যা কেবল মানুষই দিতে পারে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের এআই বিশেষজ্ঞ কিরান গিলমারি বলছেন, “মানুষের বিচারবুদ্ধি, আলোচনার ক্ষমতা, ও পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা এখনো এআইয়ের বাইরে।”
এইচআর-এর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ
মানবসম্পদ (HR) বিভাগেও এআইয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই, কর্মীদের কর্মক্ষমতা বিশ্লেষণ-সব জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে এআই। বর্তমানে প্রায় ৮৮ শতাংশ কোম্পানি নিয়োগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো না কোনোভাবে এআই ব্যবহার করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে-এই প্রক্রিয়ায় অনেক যোগ্য প্রার্থীও বাদ পড়ে যাচ্ছেন। কারণ এআই সবসময় মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্য বুঝে উঠতে পারে না।
দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-এআই শুধুই কাজ কমায় না, বরং শিক্ষা ও দক্ষতা গড়ার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পারসনের গবেষণা বলছে, দক্ষতা ঘাটতির কারণে মার্কিন অর্থনীতি বছরে প্রায় ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে। সেখানে এআই-চালিত লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো কর্মীদের সহজে নতুন কিছু শেখার সুযোগ দিচ্ছে।
তবে সতর্ক থাকতে হবে
যদিও সম্ভাবনা আছে অনেক, বাস্তবতা হলো-৮০% এআই প্রকল্পই ব্যর্থ হয় (সূত্র: র্যান্ড করপোরেশন)। কারণ? পরিষ্কার লক্ষ্য না থাকা, ভুল প্রয়োগ, কিংবা প্রয়োজন ছাড়াই এআই ব্যবহার।
ব্রিটেনের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা লুইস মটলি যেমন বলছেন, “চ্যাটবট সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, বরং কখনও বিরক্তির কারণ হয়। এআই মানে এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
এআই এক নতুন শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে। এটি যেমন কিছু চাকরি বদলে দিচ্ছে, তেমনি খুলে দিচ্ছে অসংখ্য নতুন সম্ভাবনার দরজা। তবে প্রযুক্তিকে শুধু “প্রতিস্থাপন” হিসেবে না দেখে সহযোগী হিসেবে দেখাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতন প্রয়োগের মাধ্যমে এআই হতে পারে মানুষের বড় সহায়ক-না যে প্রতিদ্বন্দ্বী। সূত্র: দ্য ন্যাশনাল