বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা এখন তুঙ্গে। ওপেনএআই, গুগল, মাইক্রোসফটের পর এবার মেটা (Meta) ঝাঁপ দিচ্ছে ‘সুপারইন্টেলিজেন্স’ অর্জনের দৌড়ে। আর এ লক্ষ্যেই মার্ক জাকারবার্গের প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল বিনিয়োগের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে স্কেল এআই নামের একটি স্টার্টআপের ৪৯% শেয়ার কিনবে তারা।
কী এই সুপারইন্টেলিজেন্স?
সাধারণ ভাষায় বললে, সুপারইন্টেলিজেন্স এমন এক ধরনের এআই-যেটি মানুষের চেয়ে সবক্ষেত্রে উন্নত পারফর্ম করতে সক্ষম। বর্তমানে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমরা দেখি, তা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ভালো পারফর্ম করলেও, মানুষের মতো সর্বাঙ্গীন বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য এখনো অর্জন করতে পারেনি। এই সর্বাঙ্গীন সক্ষমতাকে বলা হয় Artificial General Intelligence (AGI)-যার দিকে এখন ছুটছে মেটা।
নেতৃত্বে আলেক্সান্ডার ওয়াং
মেটা তাদের ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্ক ক্যাম্পাসে একটি বিশেষ ‘সুপারইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ গঠন করছে, যেখানে প্রথম পর্যায়ে থাকছেন ৫০ জন অভিজ্ঞ এআই গবেষক ও ইঞ্জিনিয়ার। এই দলের নেতৃত্ব দেবেন স্কেল এআই-এর প্রতিষ্ঠাতা আলেক্সান্ডার ওয়াং, যিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ করছেন।
স্কেল এআই কী করে?
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কেল এআই মূলত ডেটা লেবেলিং-এ দক্ষ। এআই মডেলকে প্রশিক্ষিত করতে প্রয়োজন হয় লক্ষ লক্ষ নির্ভুল, শ্রেণিবদ্ধ ডেটা। এই প্রক্রিয়ায় অপরিষ্কার বা এলোমেলো তথ্যকে ট্যাগ বা লেবেল দিয়ে অর্থপূর্ণ করে তোলা হয়, যাতে মডেলটি বুঝতে পারে কী শিখছে। এই কাজটি এখন স্কেল এআই করছে মার্কিন সামরিক বাহিনী পর্যন্ত।
কেন এত বড় বাজি?
গত কয়েক বছরে এআই গবেষণায় মেটা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। গুগলের জেমিনি কিংবা ওপেনএআই-এর জিপিটি মডেল ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে, যেখানে মেটার LLaMA 4 ও Behemoth মডেল প্রত্যাশিত ফল দিতে পারেনি। জাকারবার্গ নিজেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এসব নিয়ে। এবার তাই তিনি আগামীর জন্য লং-টার্ম বাজি ধরতে চাইছেন।
সমালোচনার মুখেও মেটা
সবাই অবশ্য এই উদ্যোগকে উৎসাহের চোখে দেখছে না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এআই বিশেষজ্ঞ মাইকেল উলড্রিজ বলেন, “এটি মেটার ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা মাত্র। মেটাভার্সে বিপুল বিনিয়োগ তারা করেছিল, কিন্তু ফলাফল হাস্যকর।”
তিনি আরও বলেন, “সুপারইন্টেলিজেন্স এখনো বহু দূরের পথ-আমাদের এআই মডেলগুলো সহজ কাজেও ব্যর্থ হয়।”
ইউনিভার্সিটি অব সারে'র গবেষক ড. অ্যান্ড্রু রোগয়স্কি অবশ্য অন্য দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, “এটি প্রমাণ করে-এআই প্রতিযোগিতা এখন কেবল প্রযুক্তি নয়, ট্যালেন্ট হান্ট বা গবেষকদের দখলে নেওয়ার লড়াই।” বিশেষ করে স্টার্টআপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা এখন বড় বড় কোম্পানির টার্গেটে।
ইউরোপের অবস্থান কী?
এই প্রতিযোগিতার পটভূমিতে ইউরোপের অনেক গবেষক আহ্বান জানাচ্ছেন-সার্ন (CERN)-এর মতো একটি ওপেন ও ট্রান্সপারেন্ট এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। এর মাধ্যমে এআই প্রযুক্তিকে কেবল কর্পোরেটের আয়ত্তে না রেখে একটি গণমুখী, বৈজ্ঞানিক প্ল্যাটফর্মে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।
মেটার এই বড় বিনিয়োগ ভবিষ্যতের এআই দুনিয়ায় কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনই বলা কঠিন। তবে এটা স্পষ্ট-‘সুপারইন্টেলিজেন্স’ ঘিরে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এখন কেবল প্রযুক্তি নয়, গবেষণা, প্রতিভা ও রাজনীতির মিশ্রণে পরিণত হয়েছে।
এজিআই কি আদৌ সম্ভব? আর সম্ভব হলেও তা মানবজাতির পক্ষে কতটা নিরাপদ, এই প্রশ্নগুলো সামনে রেখেই আমাদের এগোতে হবে।
সূত্র: রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান