চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে তারুণ্যের স্মার্টনেস হোক মেধা ও দক্ষতার সৌন্দর্যে

প্রকাশ: শনিবার, ০৭ জুন, ২০২৫
https://www.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png উজ্জ্বল এ গমেজ
https://www.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
৯০ দশকের কথা। প্রতি শুক্রবার বিকেল তিনটায় সাদা-কালো টেলিভিশনে বাংলাদেশ টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। যে বাড়িতে সিনেমা দেখাতো, সেখানে সারা গ্রামের মানুষ আসতো। যারা আগে আসতো তারা ঘরের ভেতরে, পরে আসলে মাটির ঘরে বারান্দায়। আর এর পরে আসলে উঠানে বসে বা দাঁড়িয়ে দেখতে হতো। মাঝে মাঝে ডিশ লাইনে কারিগরি সমস্যার কারণে টেভির পর্দায় নায়ক-নায়িকাদের স্পষ্টভাবে দেখা যেতো না। তখন গিয়ে ডিশ অ্যান্টেনা নাড়ানো হতো। 

ওই সময়ে শুধু বিটিভির প্রোগ্রাম দেখে তরুণরা বিনোদন উপভোগ করেছে। এর আগে জনপ্রিয় ছিল রেডিও। তরুণরা রাত জেগে রেডিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুনতো। সময়ের পালা-বদলে ভিসিপি, ভিসিআর এবং সবশেষে ক্যাবল টিভি চ্যানেল দেখেছে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে দেশে আসে বোতাম টেপা মুঠোফোন। সেটিও তারা ভালো চালাতে জানতো না। তবে তাঁরা ল্যান্ডলাইন ফোনের সাথে বেড়ে উঠছে।

মানব সভ্যতার প্রতিটি প্রজন্মেরই একটা নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। আলাদা ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকে। তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির স্বকীয়তা থাকে। এর জন্যই প্রত্যেকটি প্রজন্ম একটা থেকে অন্যটা আলাদা। তবে প্রতিটি প্রজন্মই আগের প্রজন্ম থেকে নানা দিক দিয়ে এগিয়ে থাকে। বিশেষ করে উদ্ভাবনী প্রাযুক্তিক জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতায়।

বদলে যায় তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা
একবিংশ শতাব্দিতে এসে তথ্যপ্রযুক্তি অভাবনীয় উন্নতির সুবাদে বদলে গেছে মানুষের জীবনের দৃশ্যপট। পরিবর্তনশীল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ হয়ে যাচ্ছে আপডেটেড। প্রতিদিনকার জীবন-যাপন, কাজ-কর্মে আসছে প্রযুক্তি ছোঁয়া। আর সে ছোঁয়ায় জীবন-যাপন স্টাইল ও মানসিকতা, চিন্তা-ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির হচ্ছে পরিবর্তন। স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। আজ বাসার সাহায্যকারী রিহিমা ও রিকশাচালক করিমের হাতেও রয়েছে একটা স্মার্টফৈান। ব্যবহার করছেন সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, টিকটক। ভিডিও কলে কথা বলেছেন মেসেঞ্জার, ইমু, হোয়াটসঅ্যাপে। স্মার্টলি টাকা লেন-দেন করছেন মোবাইলে থাকা বিকাশ, নগদ, উপায়, রকেট অ্যাপে। অন্যদিকে, দেশের তরুণদের নিত্যদিনের জীবনকে যাদুর মতো প্রভাবিত করছে বিশ্বের নতুন নতুন প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি ছোঁয়ায় তরুণ প্রজন্ম হয়েছে স্মার্ট। এখন তাঁরা সবকিছু প্রযুক্তির সাহায্যে করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রযুক্তির ভাষায় ভাবতে, চিন্তা করতে ও সেগুলো প্রকাশ করতে পছন্দ করে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের তাঁদের দেওয়া নাম ‘জেন-জি’ ডাক শুনতেও ভাল লাগে। তরুণ প্রজন্মের মানসিকতার এই রূপান্তর নতুন প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতার পূর্বাভাস দেয়।

জেন-জি কারা, কি তাঁদের পরিচয়?
কেয়ারগিভার্স অব আমেরিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধের তথ্যমতে, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে এবং ২০১০ এর দশকের প্রথম দিকে জন্মগ্রহণকারীদের বলা হয় ‘জেনারেশন জেড’ বা সংক্ষেপে ‘জেন জি’। আরও সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যারা জন্মগ্রহণ করেছন তারা এই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। ২০২৪ সালের হিসেবে সবচেয়ে বড় জেড সদস্যের বয়স ২৭, আর সবচেয়ে ছোটদের বয়স ১২ বছর। এদের আগের প্রজন্মের ক্যাটাগরি ‘জেনারেশন ওয়াই’, যাদেরকে বলা হয় ‘মিলেনিয়াল’। এদের জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে।

জেন জির আরও একটি নাম হচ্ছে ‘জুমার্স’। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে জেডের পূর্বসূরিদের নাম। এখানে ‘জেড’ অক্ষরের সঙ্গে মূলত ‘বুমার্স’ শব্দের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। ‘বুমার্স’ হলো বেবি বুমার্সের সংক্ষিপ্ত রূপ, যে প্রজন্মের আগমন ঘটে ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালে। এদের পরে আসে ‘জেনারেশন এক্স’। সেই অর্থে বুমারদের বলা যেতে পারে জেন জিদের প্রপিতামহ। জেন জি’র উত্তরসূরিরা ‘জেনারেশন আলফা’ নামে অভিহিত, যাদের জন্মকাল ২০১০ থেকে ২০২৪।

জেড প্রজন্মের অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে ‘আই’ বা ‘ইন্টারনেট জেনারেশন’, ‘হোমল্যান্ড জেনারেশন’, ‘নেট জেন’, ‘ডিজিটাল নেটিভস’ বা ‘নিও-ডিজিটাল নেটিভস’, ‘প্লুরালিস্ট জেনারেশন’ ও ‘সেন্টিনিয়াল্স’। ইন্টারনেট ও পোর্টেবল ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে প্রযুক্তিগতভাবে অক্ষর-জ্ঞান না থাকলেও এরা ডিজিটাল নাগরিক হিসেবে অভিহিত হয়। আগের প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা যেখানে আটকানো ছিল বইয়ের মাঝে, সেখানে এই প্রজন্মের প্রত্যেকেই ইলেক্ট্রনিক ও স্মার্ট ডিভাইসের প্রতি আসক্ত।

যে কারণে সাধারণ মানুষ থেকে জেন-জিরা আলাদা
জেন-জিরা তাদের কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুবই উৎফুল্ল থাকেন। অন্যান্য জেনারেশনের সঙ্গে কাজ করতে তাঁদের অনেক বেগ পেতে হয়। তাঁদের দক্ষতা ও কাজ করার প্রক্রিয়া অন্যান্যদের তুলনায় আলাদা হয়। জেন জিরা সাধারণত কোনো নিয়ম মেনে চলতে আগ্রহী নয়। তারা সবার সঙ্গে একই রকম আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে চায়।  

প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, জেন-জির মূল বৈশিষ্ট্য হলো তারা কর্মদক্ষতার চেয়ে বুদ্ধিমত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা কোনো ধরনের সমালোচনাকে ভয় করে না। তারা সবসময় বাস্তবসম্মত শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়। আগের প্রজন্ম যেখানে ৫-১০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদি পড়ায় অভ্যস্ত ছিল, সেখানে এই প্রজন্ম সর্বোচ্চ ৪ বছর মেয়াদি স্নাতকে সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁদের নিজস্ব কাজের ধরন থাকে। তাঁরা তাদের মতো করে কাজ করতে পছন্দ করে। কর্মক্ষেত্রেও যোগাযোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নতা।

জেন-জিদের স্মার্টনেস  
তাঁরা প্রতিদিনকার জীবনযাপনে পৃথিবীর সেরা ও আলোচিত প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত। তাঁদের রয়েছে প্রাযুক্তিক জ্ঞান ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের এবং পৃথিবীকে উন্নত করার দক্ষতা। এই প্রজন্মের স্মার্টনেস বলতে মূলত, প্রযুক্তি-বিষয়ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ দক্ষতা, উন্নত মানসিকতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতাকে বোঝানো হয়। এ প্রজন্মের স্মার্টনেসকে উপলব্ধি করতে তাদের মন-মানসিকতা, চিন্তা-ভাবনা, দুনিয়ার সবশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা ও জীবনধারা বিশ্লেষণ করতে হবে।
 
প্রাযুক্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা
জেন-জিরা প্রযুক্তির যুগে জন্মগ্রহণ করে প্রযুক্তিবেষ্টিত পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। তাঁরা জন্মের পর থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন স্মার্ট টুলস, যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) চ্যাটবট ও অ্যাপের সাথে পরিচিত। তাই তাঁদের বিশ্বের নতুন নতুন ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্রুত শেখা এবং ব্যবহার করার দক্ষতা অনেক বেশি। ফলে তাঁরা ইন্টারনেট বিশ্বে অন্যান্যদের চেয়ে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। একইসঙ্গে স্মার্টফোন, পাওয়ার ব্যাংক, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট ওয়াচ, হেডফোন, এয়ার বাট, স্মার্ট স্পিকার, স্মার্ট ফিটনেস ডিভাইস এবং অন্যান্য আধুনিক ডিভাইস তারা সাবলীলভাবে ব্যবহার করতে পারে। প্রত্যেকের ঘরে অবাধ ও সহজলভ্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট থাকার কারণে তাঁরা ছোটবেলা থেকেই অনলাইনে ও ইউটিউবে বিভিন্ন স্মার্ট ক্যারিয়ার এক্সপার্ট ও আইটি প্রফেশনালদের তৈরি ভিডিও দেখে   কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, কোডিং, এথিক্যাল হ্যাকিং, ভিডিও এডিটিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটেং এবং গেম ডেভেলপমেন্টের কাজ শিখছেন।

বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষকদের ভাবনায় যোগ হলো নতুন পালক
বিশ্বজুড়ে এখন চ্যাট-জিপিটির জয়জয়াকার। চ্যাটজিপিটি একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক চ্যাটবট বা সার্চ টুলস। এটিকে বলা হয় ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল টুলস’।  ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর আমেরিকান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ওপেন এআই কর্তৃক এটি চালু করা হয়। শক্তিশালী মেশিন লার্নিং মডেলটি কয়েক সেকেন্ডে হাজারো শব্দ লিখতে বা নিমেষে জটিল কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। এর মধ্য দিয়ে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, উকিল, গবেষক, ফ্রিল্যান্সার, সব শ্রেণির মানুষের জীবনে যোগ হলো নতুন পালক।

চ্যাট-জিপিটির প্রম্পটে সঠিক ও স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারলে এটি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দ্রুত ও নির্ভুলভাবে জানাতে সক্ষম। ব্যবহারকারীর প্রম্পট অনুসারে ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্টের মডিউল, প্রোগ্রামারের প্রয়োজনীয় কোডিং শ্যাম্পল, শিল্পীর গান, কবির কবিতাও লিখে দেয় এ চ্যাটবট। চ্যাট-জিপিটি ব্যবহার করে কেউ ইচ্ছা করলে গোটা উপন্যাসই লিখিয়ে নিতে পারেন। টেক্সটভিত্তিক প্রোগ্রাম হওয়ায় চ্যাট-জিপিটি গবেষণা ও শিক্ষা খাতে অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলটি তরুণদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। কারণ তারা প্রতিদিনকার জীবনের  প্রয়োজনীয় সব কাজই কয়েকটি প্রম্পট লেখার মাধ্যমে সহজে সেরে নিতে পারছেন।
 
সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তা
তাঁদের মধ্যে রয়েছে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা। তাঁরা নতুন ও অভিনব পন্থায় চিন্তা করতে সুদক্ষ। তাঁরা ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে নিত্যনতুন রিলস বানিয়ে সেগুলো শেয়ার করতে পারদর্শী। তাঁরা সবসময় সৃজনশীল কনটেন্ট তৈরি করতে ভালোবাসে, যা সোশ্যাল মিডিয়া  প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক আলোচনার ঝড় তোলে। এভাবে ভিজ্যুয়াল ও ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিজের ব্র্যান্ডিং করে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে ভালোবাসেন।

জেন-জিরা উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনার জন্য বেশি পরিচিত। তাঁরা উদ্ভাবনী স্টার্টআপ শুরু করা, নতুন অ্যাপ তৈরি করা বা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়নের দিকে বেশি আগ্রহী। তাঁদের মধ্যে রয়েছে মাল্টিটাস্কিং দক্ষতা। তাঁরা একই সময়ে একাধিক কাজ করতে সক্ষম।যেমন, একদিকে অনলাইন ক্লাস করছে, অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রল করছে বা কোনো অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করছেন। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে জন্ম হওয়ায় তাদের মধ্যে রয়েছে তথ্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ। তাদের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের সক্ষমতা অসাধারণ।যেকোনো বিষয়ে দ্রুত রিসার্চ করা এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে বের করার ক্ষমতা তাদের অন্যতম শক্তি। ফ্যাক্ট-চেকিং টুলসের সাহায্যে তাঁরা খুব সহজে ফেক নিউজ বা ভুয়া তথ্য খুঁজে বের করে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করতে পারেন।

নতুন সমস্যার দ্রুত সমাধান দেন জেন-জিরা
 তাঁরা উদ্ভাবনী চিন্তা করতে ভীষণ ভালবাসেন। চলমান সমাজের সৃষ্ট নতুন সমস্যার জন্য দ্রুত সমাধান বের করার দক্ষতা তাদের অসাধারণ। প্রথাগতভাবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চাকরি করার বদলে স্টার্টআপ, এন্টারপ্রেনিউরশিপ এবং সৃজনশীল উদ্যোগ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন তাঁরা।

জেন-জিরা সব সময় ব্যতিক্রমী শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে তাঁরা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে নতুন শিক্ষামাধ্যম এবং প্রক্রিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। যেমন, ই-লার্নিং ও অনলাইন কোর্স। ইউটিউব, কোর্সেরা এবং খান একাডেমির মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে শিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাঁরা। একাডেমিক ডিগ্রির পাশাপাশি তারা বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনে বা স্কিল ডেভেলপমেন্টে মনোযোগী। যেমন, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট রাইটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট।

সময়টা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্যমতে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মূলত, প্রযুক্তির বিপ্লব, যা পৃথিবীর মানুষকে এক লাফেই ১০০ বছর সামনে নিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ পরিবর্তন সব মানুষের জীবনমান উন্নত করবে, আয় বাড়াবে সব শ্রেণির মানুষের। প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প ও অর্থনীতির সব ক্ষেত্র। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামে রূপান্তরিত করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে অভাবনীয় উন্নত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হবে পাড়া-মহল্লায় দোকানে কেনা-বেচার মতোই সহজ। মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বেশির ভাগ সমস্যা নির্ণয়, সমস্যা বিশ্লেষণ, সমস্যার সমাধান, মেশিন টু মেশিন যোগাযোগ, ইন্টারনেট অব থিংস, সম্মিলিতভাবে এসবকেই একত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে বোঝানো হচ্ছে।

জাদুকরী শক্তির নাম আইওটি
সকালে অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙার পর একজন ব্যক্তি ঘড়ির স্টপ বোতামে চাপ দিলেন। ঘড়িটি তখন ঘরের অন্যান্য যন্ত্রে (ডিভাইস) ব্যক্তির ঘুম থেকে ওঠার বার্তাটি পৌঁছে দেবে। এ বার্তা পেয়ে ঘরের বাতি জ্বলে উঠবে, জানালার পর্দা খুলে যাবে, আবার খাবার ঘরে থাকা কফি মেশিনও নির্দিষ্ট সময় এক কাপ কফি বানিয়ে ফেলবে। আবার দেখা যাবে, ওই ব্যক্তি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে গ্যারেজে থাকা গাড়িও। এ ঘটনায় যত যন্ত্র ব্যবহার হয়েছে, তার সব মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত ছিল। আর এ পুরো প্রক্রিয়াই হলো ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)। এ যুগে আমরা এখন বাস করছি।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিশেষত্ব
অন্যান্য শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লব শুধু মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে যন্ত্র ও প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে দ্রুততর করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমকে আরো বেশি গতিশীল ও নিখুঁত করে তুলছে। ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসছে এ ভার্চুয়াল জগতেরই আরো বড় পরিসর নিয়ে।

ক্লাউস সোয়াব চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে, সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতা
এ বিপ্লব অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। মেশিন ডিভাইস, সেন্সর, মানুষের পরস্পরের মধ্যে ইন্টারনেট অব থিংস অথবা ইন্টারনেট অব পিউপলের (আইওপি) মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন, বিগ অ্যানালিটিকস, গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং, অগমেন্টেড রিয়ালিটি/ওয়্যারেবল টেকনোলজি, ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন, থ্রিডি প্রিন্টিংসহ আধুনিক প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী সেবাদান প্রক্রিয়া বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অটোমেশনের দিকে ধাবিত করছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং স্বয়ংক্রিয়করণ এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।

কম দক্ষতার চাকরি বিলুপ্ত, তৈরি হবে নতুন কর্মজগত
তথ্যপ্রযুক্তি গবেষকদের তথ্যানুযায়ী, আগামী দুই দশকের মধ্যে মানবজাতির ৪৭ শতাংশ কাজ স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে হতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে শ্রমনির্ভর এবং তুলনামূলকভাবে কম দক্ষতানির্ভর চাকরি বিলুপ্ত হবে। এর বিপরীতে তৈরি হবে নতুন ধারার বিভিন্ন কর্মজগত। তৈরি হবে উচ্চ দক্ষতানির্ভর  নতুন কর্মবাজার। নতুন যুগের এসব চাকরির জন্য প্রয়োজন উন্নত ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে কারিগরি দক্ষতা। ডাটা সায়েন্টিস্ট, আইওটি এক্সপার্ট, রোবটিকস ইঞ্জিনিয়ারের মতো আগামী দিনের চাকরিগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী হবে জেন-জি প্রজন্মের জনগোষ্ঠীরা।

কল-কারখানায় মানুষের জায়গা দখল করছে যন্ত্রমানব
অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তির জোয়ারে ভাসছে পুরো বিশ্ব। উন্নত বিশ্বে কল-কারখানায়, অফিস-আদালতে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে এআই-নির্ভির রোবটিকস বা যন্ত্রমানব। চাকরি থেকে শুরু করে ব্যবসার ক্ষেত্র, কৃষি কাজে, স্কুল-কলেজ, উদ্ভাবন, গবেষণা, হাসপাতালে চিকিৎসায়, সব জায়গায় রোবটিকসের মতো প্রযুক্তি জায়গা করে নিচ্ছে।বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে এ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে দ্রুতগতিতে। তৈরি পোশাক শিল্প  বড় পরিসরে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে ধাবিত হওয়ার ফলে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্থনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে। প্রথম সম্ভাব্য প্রভাব হবে লাখ, লাখ শ্রমজীবী দিনমজুরদের চাকরি হারানো। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস এবং অটোমেশনের দিকে এর স্থানান্তর হলে বর্তমান শিল্পে নিযুক্ত বড়সংখ্যক শ্রমিক উল্লেখযোগ্য চাকরি হারাতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে চাকরি হারাবেন লাখ লাখ তৈরি পোশাক কর্মী।

বিশ্বের কর্মবাজারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে কর্মবাজারে। অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে ধীরে ধীরে শিল্প কল-কারখানা হয়ে পড়ছে যন্ত্রনির্ভর। মার্কিন টেক জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাপলের হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফক্সকন এরই মধ্যে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করে তার পরিবর্তে রোবটকে বেছে নিয়েছে। পোল্যান্ডের বিখ্যাত এক বহুজাতীয় পানীয় সংস্থা, ডিক্টেডার ঠিক করেছে প্রতিষ্ঠানের চাকরি দেওয়া বা নেওয়ার বিষয় দেখভাল করবে এআই। রোবটকে দেওয়া  হয়েছে কোম্পানির সিইওর দায়িত্ব।সংস্থার সম্পূর্ণ লাগাম তুলে দেওয়া হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের হাতে। ওই বহুজাতিক পানীয় সংস্থার ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এখন থেকে লাভ-ক্ষতি, মার্কেটিং কৌশল, বিজনেস স্ট্র্যাটেজিসহ যাবতীয় বিষয় দেখবে এআই।এছাড়াও বিগত বছরগুলোয় চীনের কারখানাগুলোয় রোবট ব্যবহারের হার বেড়েছে বহুগুণে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রোবটের কারণে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারাবে।

দুনিয়াজুড়ে যেসব প্রযুক্তির জয়-জয়কার
প্রযুক্তির দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত ও দ্রুত পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে।  চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য শক্তির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে প্রযুক্তি। একইসঙ্গে দেশগুলোতে ৫জি নেটওয়ার্ক, টেকসই ও সবুজ প্রযুক্তি, ক্রিপ্টোকারেন্সির, ব্লকচেইন, এজ কম্পিউটিং, মেটাভার্স, জৈবপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ গবেষণা, দূরবর্তী শিক্ষা সিস্টেম, ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি, অ্যাডভান্স টেকনোলজি, ইন্সট্রাকশনাল টেকনোলজি রোবটিকস, আইটি/আইটিএস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভেরি লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেশন (ভিএলএসআই), নেভিগেশন (ভেহিকেল), হার্ডওয়্যার নেভিগেশন, ই-কমার্স, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, নেটওয়ার্ক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
 
বিশ্বের কোন দেশের জেন-জির সংখ্যা কত
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই জেন-জি। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তাঁদের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, জেন-জি জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই জেন-জিরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি স্তরে সেই জেন-জিরাই জোগান দিয়ে আসছে। আজও বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দিচ্ছে তাঁরা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আগামী ৩০ বছরজুড়ে তরুণ বা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে।

বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি
বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত হয় বেকার, নয়তো তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশালসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।

দেশে সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইন শ্রমশক্তির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হচ্ছে ভারত; যাদের প্রায় ২৪ শতাংশ গ্লোবাল ফ্রিল্যান্সার ওয়ার্কার আছে। এর পরের অবস্থানটিই বাংলাদেশের, অনলাইন শ্রমশক্তিতে যাদের অবদান হচ্ছে ১৬ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যাদের ফ্রিল্যান্সার হচ্ছে ১২ শতাংশ। তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে নিয়মিত কাজ করছে পাঁচ লাখ ফ্রিল্যান্সার। আর মোট ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৬ লাখ ৫০ হাজার। প্রতি বছর ফ্রিল্যান্সররা ১০ কোটি ডলার আয় করে থাকেন।

বাংলাদেশে এখন অনেক শিক্ষিত নারী সংসারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং কাজ করছে। তারা প্রথাগত সাংসারিক দায়িত্বের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্রিল্যান্স কাজকে ক্যারিয়ার সংকটের সমাধান হিসেবে দেখছে। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের নারীরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে এখন পুরুষের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। আর নারীদের অংশগ্রহণে এ সেক্টর আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

চাকরি নয়, ব্যবসাতেই বেশি আগ্রহ জেন-জিদের
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক ব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে, জেন-জি প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষ ধরাবাঁধা চাকরির চেয়ে ব্যবসা করতেই বেশি আগ্রহী। স্যানট্যানডার ব্যাংক যুক্তরাজ্যের সমীক্ষায় জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের এ প্রবণতা উঠে আসে। সমীক্ষার তথ্যানুসারে, ৭৬ শতাংশ জেন-জি কারও অধীনে কাজ করতে আগ্রহী নন। ৯টা-৫টার একঘেয়ে কর্মজীবন তাঁদের পছন্দ নয়। জেন-জিদের ৭৭ শতাংশ বিশ্বাস করেন, তাঁদের ব্যবসা শুরু করার যোগ্যতা আছে।ইয়াহু ফাইন্যান্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে এখানে জেন-জিদের বড় ধরনের ব্যবধান দেখা যায়। তাঁরা নিজেই নিজের বস বা কর্তা হতে চান। অথচ মিলেনিয়ালদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল ৫৭ শতাংশ। জেনারেশন এক্সের মধ্যে ৩৬ শতাংশ ও বেবি বুমারদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা গেছে।

ফ্রিল্যান্সিংকেই বেশি পছন্দ করেন জেন-জিরা
চলতি বছর সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘আপওয়ার্ক’যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৭০ জন ‘জেন-জি’ প্রজন্মের মানুষের ওপর আরেকটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সবাই ছিলেন ফ্রিল্যান্সার। দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ জেন-জি সপ্তাহে গড়ে ৪০ ঘণ্টা অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করেন। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ জেন-জি কর্মী দুই বছরের বেশি সময় ধরে ফ্রিল্যান্সিং করছেন। তাঁরা সেটাই করে যেতে চান। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, পেশা বলতে এতকাল মানুষ যা বুঝেছে, সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চান তাঁরা।
 
জেন-জিরা আর্থিকভাবে অনেক বেশি প্রভাবশালী
দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন অনুসারে, সময়ের পরির্তনে জেন-জিরা বড় হচ্ছে। তাঁদের অনেকেই এখন দায়িত্বশীল নানা পদে কাজ করছে। উন্নত দেশগুলোতে  ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২৫০ মিলিয়ন মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের প্রায় অর্ধেক এখন বিভিন্ন খাতে কাজ করছে, অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন অর্থনৈতিকভাবে।যুক্তরাষ্ট্রে ৬ হাজারের বেশি জেন-জি এখন প্রধান নির্বাহী। সহস্রাধিক রয়েছেন রাজনীতিতে। তার মানে এটাই দাঁড়ায়, এই প্রজন্ম আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।

দেশের ১৮-২৪ বছর বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি
পৃথিবীতে কয়েকশ সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক আছে। ব্লগভিত্তিক, ছবি ও ভিডিওভিত্তিক কিংবা চ্যাট বা বার্তাভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া অহরহ। যার মধ্যে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, টুইটারই সবচেয়ে জনপ্রিয়। চ্যাটভিত্তিক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যেমন, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি। আবার ব্লগভিত্তিক বিভিন্ন সাইট আছে যেমন, ফেসবুক, টাম্বলার, টুইটার (বর্তমানে ‘এক্স’ নামে পরিচিত) ইত্যাদি। ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ইউটিউবও কম জনপ্রিয় নয়। বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ৩০-এর অধিক।

সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম মানুষের অন্যতম যোগাযোগমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সরাসরি মিথস্ক্রিয়া না হলেও পৃথিবীজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে কয়েক কোটি মানুষ। এখানে চাইলেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। তাইতো স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকা বেশিরভাগ মানুষই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। এ মাধ্যম ঘিরে এক আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছে মানুষের। প্রায় সবাই দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করতে পছন্দ করেন। পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে; যা সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর প্রায় সব ব্যবহারকারীই সক্রিয়। এর পরই রয়েছে ইউটিউব; প্রতি মাসে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৫০ কোটির মতো। ৩ নম্বরে রয়েছে ফেসবুকেরই আরেকটি সাইট হোয়াটসঅ্যাপ, ব্যবহারকারী ২০০ কোটি।

পোল্যান্ডভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যানালিটিকস প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের অক্টোবরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমান ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১০০, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারী (৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ) পুরুষ। এছাড়া বাংলাদেশের ১৮-২৪ বছর বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি। মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ একবারের জন্য হলেও ফেসবুকে প্রবেশ করেছে। পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে; যা সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর মধ্যে সর্বোচ্চ।

জেন-জিদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের চ্যালেঞ্জ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে জেন-জিদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারে রয়েছে অফুরান সম্ভাবনা। তাঁরা অনেক স্মার্ট, মেধাবী, কঠোর পরিশ্রমী, দূরদর্শী, অধ্যবসায়ী ও সৃজনশীল। সময়ের পরিবর্তনে ভবিষ্যতে ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রগুলো অনেক বৈচিত্র্যময় হবে। তাঁরা  ভবিষ্যতের কর্মজগতে প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মধ্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারবে। তাঁরা প্রযুক্তি, পরিবেশ, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক সচেতনতা সবকিছু মিলিয়ে কর্মজীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। তবে তাঁদের জন্য ক্যারিয়ারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে দ্রুত পরিবর্তিত নতুন প্রযুক্তি, মানসিক চাপ, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা অর্জন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের মনকে শক্ত করতে হবে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে নতুন দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হবে।  

তারুণ্যের স্মার্টনেস হতে হবে মেধা ও দক্ষতার সৌন্দর্যে
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী,  বর্তমানে দেশের  ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটি ১৯ লাখ। মোট ইন্টারনেট গ্রাহকের ৯০ দশমিক ৭৯ শতাংশ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। গ্রাহকদের ১১ কোটি ৯৭ লাখের বেশি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ২১ লাখ। সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না থাকলেও মোবাইল ইন্টারনেট সহজলভ্য। সবার হাতে রয়েছে একটা করে স্মার্টফোন। কারো কারো আবার দুটি বা তিনটিও রয়েছে। তরুণরা চাইলে শুধু এই স্মার্টফোনে মোবাইল ইন্টারনেটের সাহায্যে নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন শুধু আন্তরিক সদিচ্ছা, দৃঢ় মনোবল, সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ। আগামী ৩০ বছর সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে যেসব প্রযুক্তি, সেগুলো এখানে আলোচনা করা হয়েছে। বৈশ্বিক বিশ্বের প্রযুক্তির প্রভাব বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে পড়া শুরু করেছে। আগামীতে আরও পড়বে। তাই, এখন যারা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, তাদের সারা বিশ্বের চাকরির বাজারের চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে, সে অনুসারে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। আর যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে, তাদেরও চলমান সময়ের প্রযুক্তি বিশ্বের খবরগুলো পড়ে, ভাল মতো জেনে-বুঝে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার-ভিত্তিক বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে। এর জন্য তাদের দিক-নির্দেশনা  দিতে অভিভাবকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিত্যদিনের বিভিন্ন ধরনের নজরকাড়া স্ট্যাটাস, নিজের আকর্ষণীয় ছবি পোস্ট দেওয়াকে তাঁরা স্মার্টনেস মনে করেন। প্রকৃত স্মার্টনেস তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আর পোস্টে ফুটে উঠে না। সোশ্যাল মিডিয়া স্মার্ট যুগের একটা অংশ মাত্র। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, প্রযুক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে সেটি বিশেষ কোন ক্যারিয়ারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো স্মার্টনেস। তারুণ্যের অফুরান মেধাকে প্রকৃত অর্থে প্রাযুক্তিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও সদ্ব্যবহার করে আলোকিত ব্যক্তিত্ব গড়ার নাম হতে পারে স্মার্টনেস। তারুণ্যের স্মার্টনেস হতে হবে মেধা ও সৃজনশীল ভাবনার সৌন্দর্যে। (লেখাটি সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর ২০২৪ সালের বড়দিন সংখ্যায় প্রকাশিত)

লেখক: উজ্জ্বল এ গমেজ, লেখক ও সাংবাদিক। 
image

আপনার মতামত দিন