চীন দীর্ঘদিন ধরেই অনলাইন সেন্সরশিপ ও নজরদারিতে অন্যতম কঠোর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এবার দেশটি ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে- "কেন্দ্রীয় ভার্চুয়াল আইডি" নামক নতুন একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে। সরকার বলছে, এটি নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ অনলাইনে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর বড় হুমকি।
একটি আইডি, একাধিক প্ল্যাটফর্ম
এই নতুন ভার্চুয়াল আইডি ব্যবস্থায় নাগরিকদের আর প্রতিটি ওয়েবসাইট বা অ্যাপে আলাদা পরিচয় তথ্য দিতে হবে না। বরং একটি Unified Virtual Identity ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লগইন করতে পারবেন।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ এই আইডির জন্য নিবন্ধন করেছে, যদিও চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে।
জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের এক সাইবার নিরাপত্তা কর্মকর্তা সিনহুয়াকে বলেন, এই সেবা ‘সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়’ ব্যবহার করা যাবে। তবে বিভিন্ন খাতকে এতে সংযুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘এর লক্ষ্য একটি নিরাপদ, সুবিধাজনক, কর্তৃত্বপূর্ণ ও দক্ষ পরিচয় যাচাই পদ্ধতি গড়ে তোলা।’
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রফেসর হাওচেন সান বলেন, ‘সরকার যদি চায়, তাহলে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে মানুষকে এই ব্যবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব। একসময় এমন হবে যে আপনি না চাইলেও এই ব্যবস্থায় ঢুকতে বাধ্য হবেন।’
তিনি আরও বলেন, একটি কেন্দ্রীয় ডেটা প্ল্যাটফর্ম মানেই একটি বড় হ্যাকার বা বৈরী শক্তির লক্ষ্য হওয়া।
সরকারের ভাষ্য বনাম বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা
সরকার বলছে, এই পদক্ষেপ “নিরাপদ, দক্ষ ও কর্তৃত্বপূর্ণ” পরিচয় যাচাই ব্যবস্থা তৈরি করবে। পাশাপাশি, এটি ডেটা লিকের ঝুঁকি হ্রাস করবে এবং ডিজিটাল অর্থনীতিকে সুশৃঙ্খল করবে। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ভিন্ন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিয়াও চিয়াং একে "ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্রের অবকাঠামো" হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
ব্যক্তিস্বাধীনতার সংকট ও নজরদারির ভয়
চীনে ইতোমধ্যেই প্রতিটি অনলাইন অ্যাকাউন্টে পরিচয় যাচাই বাধ্যতামূলক। বেনামি থাকা প্রায় অসম্ভব। নতুন এই কেন্দ্রীয় ভার্চুয়াল আইডি ব্যবস্থা সেই কঠোরতাকে আরও একধাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো হবে?
>>সরকার চাইলে রিয়েল-টাইমে ব্যবহারকারীকে শনাক্ত ও ব্লক করতে পারবে।
>>একক প্ল্যাটফর্ম থেকে সমস্ত প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে।
>>ব্যবহারকারীর ডিজিটাল গতিপথ পুরোপুরি ট্র্যাক করা যাবে।
মানবাধিকার সংস্থা China Human Rights Defenders এর গবেষক শেন ই বলেন, “সরকার যখন খুশি তখনই আপনার অনলাইন চলাফেরা ট্র্যাক করতে পারবে।”
আইনি প্রক্রিয়া ও বিরোধিতার ইতিহাস
২০২৩ সালের জুলাইয়ে এই নীতির খসড়া উন্মুক্ত করে সরকার জনমত গ্রহণ করে। বহু আইনবিদ, প্রযুক্তিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী এর বিরোধিতা করেন। তবুও প্রস্তাবনায় খুব একটা পরিবর্তন আনা হয়নি।
সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর লাও দোংইয়ান একে “নাগরিকদের গায়ে নজরদারি ডিভাইস বসানো” বলে মন্তব্য করেছিলেন। ফলাফল, তাঁর ওয়েইবো পোস্ট দ্রুত মুছে ফেলা হয় এবং অ্যাকাউন্ট তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়।
গোপনীয়তা না নিরাপত্তা: কোন দিকে চীন?
চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিনহুয়া একে বলছে “ব্যক্তিগত তথ্যের বুলেটপ্রুফ ভেস্ট”। অথচ বাস্তবে, ২০২২ সালে চীনের একটি পুলিশ ডেটাবেইসে ১০০ কোটির বেশি নাগরিকের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় ডেটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে হ্যাকারদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এমন বাস্তবতায়, এই আইডি আসলে কতটা নিরাপদ, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রযুক্তির রূপান্তর, নাকি শৃঙ্খল?
চীনের কেন্দ্রীয় ভার্চুয়াল আইডি পরিকল্পনা ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে ব্যক্তিস্বাধীনতা সীমিত করার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সরকার যেটিকে সুরক্ষা বলছে, সেটি ব্যবহারকারীদের চোখে পরিণত হচ্ছে ডিজিটাল শৃঙ্খলে। এই আইডি বাধ্যতামূলক না হলেও, বাস্তব পরিস্থিতিতে নাগরিকেরা বাধ্য হচ্ছেন এতে অংশ নিতে-এবং এটাই ভবিষ্যতের ‘নতুন সাধারণ’ হয়ে উঠছে। সূত্র: সিএনএন