বিশ্বে এখনো কোটি কোটি মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনুন্নত অবকাঠামো, দুর্গম অঞ্চল কিংবা অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সেখানে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। এই জটিল সমস্যার এক অভিনব সমাধান নিয়ে এসেছে গুগলের উদ্ভাবনী গবেষণাগার Google X, যা ‘মুনশট ফ্যাক্টরি’ নামেও পরিচিত। তাদের নতুন উদ্ভাবন-‘টারা’ (Taara) চিপ-একটি আঙুলের নখের আকারের সিলিকন ফোটোনিক্স চিপ, যা কোনো ক্যাবল ছাড়াই অদৃশ্য আলো ব্যবহার করে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে।
লুন থেকে টারায়: এক প্রকৌশলীর অদম্য অভিযাত্রা
টারা প্রকল্পের নেতৃত্বে আছেন গুগলের প্রযুক্তিবিদ মহেশ কৃষ্ণস্বামী, যিনি এর আগে বিখ্যাত Project Loon-এ কাজ করেছেন। লুন প্রকল্পে বেলুনের মাধ্যমে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হলেও তা নানা সীমাবদ্ধতায় ২০২১ সালে বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকেই আসে নতুন ভাবনা-আলোর মাধ্যমে তথ্য পাঠানো। এই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় টারা।
কীভাবে কাজ করে টারা?
টারার মূল শক্তি এর অত্যাধুনিক সফটওয়্যার-নিয়ন্ত্রিত আলোক রশ্মি। এই চিপ ডিজিটাল তথ্যকে আলোয় রূপান্তর করে নির্দিষ্ট দিকে পাঠায়, আর অপরপ্রান্তে থাকা আরেকটি টারা সেটি গ্রহণ করে তথ্য পুনরুদ্ধার করে। পরীক্ষাগারে গবেষকেরা কয়েক কিলোমিটার দূরে সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইট গতিতে ডেটা আদান-প্রদান করেছেন-যা স্টারলিংকের চেয়েও প্রায় ১০০ গুণ দ্রুত।
কেন টারা এত গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমানে সমুদ্রের তলদেশ বা ভূগর্ভে ফাইবার অপটিক ক্যাবল বসিয়ে ইন্টারনেট অবকাঠামো তৈরি করা হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু টারা প্রযুক্তি দিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় স্থাপন করা সম্ভব একটি কার্যকর সংযোগ ব্যবস্থা। এটি বিশেষভাবে উপযোগী হবে-
>>পাহাড়ি অঞ্চল
>>ঘন বনাঞ্চল
>>ছোট দ্বীপ বা নদী পারের শহর
>>প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা।
প্রযুক্তিগত সুবিধা: ব্যান্ডউইথের চাপ ছাড়াই বিস্তৃত সংযোগ
টারার ব্যবহৃত আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে ওভারল্যাপ করে না, ফলে এর ব্যান্ডউইথ সংকট বা সংঘাত হয় না। এতে অন্যান্য মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ওয়াইফাই-এর ওপর চাপ না পড়ে নিজস্ব পথেই ডেটা পাঠানো সম্ভব হয়।
২০২৬ সালে বাজারে আসা তাদের নতুন একটি পণ্যে এই চিপ ব্যবহৃত হবে। যদিও সেই পণ্যের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি, তবে গবেষক ও উদ্ভাবকদের আহ্বান জানানো হয়েছে-এই প্রযুক্তির আরও ব্যবহারযোগ্যতা খুঁজে বের করতে। গুগলের টারা চিপ ইন্টারনেট সংযোগ প্রযুক্তিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। অদৃশ্য আলো ব্যবহার করে সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইট গতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান সত্যিই বিস্ময়কর।
বাস্তব প্রয়োগ: কঙ্গো থেকে কোচেলা
এখন পর্যন্ত ১২টি দেশে টারা প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ কঙ্গোর দুই শহর-ব্রাজাভিল ও কিনশাসা। নদীর দুই পাড়ে অবস্থিত শহর দুটি আগে ইন্টারনেট ব্যয়ে ভিন্নতায় ভুগছিল। কিন্তু টারা লাইটব্রিজ বসানোর পর উভয় শহরেই এখন একই দামে উচ্চগতির সংযোগ মিলছে।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কোচেলা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল এবং গুগলের বে ভিউ ক্যাম্পাসে এই প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে ফাইবার কেবল পৌঁছানো ছিল প্রায় অসম্ভব।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: মেশ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পথে
টারার পরবর্তী ধাপ হলো বহু চিপের সমন্বয়ে ‘মেশ নেটওয়ার্ক’ তৈরি করা। যেখানে একাধিক টারা ডিভাইস একে অপরের সঙ্গে ডেটা বিনিময় করে বিশাল অঞ্চলে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেবে। এর ফলে গ্রামীণ, উপেক্ষিত কিংবা দুর্যোগ কবলিত এলাকায় দ্রুত, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য সংযোগ পৌঁছানো সম্ভব হবে।
২০২৬-এর পণ্য প্রস্তুতিতে টারা
গুগল এক্স জানিয়েছে, ২০২৬ সালে বাজারে আসা তাদের নতুন একটি পণ্যে এই চিপ ব্যবহৃত হবে। যদিও সেই পণ্যের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি, তবে গবেষক ও উদ্ভাবকদের আহ্বান জানানো হয়েছে-এই প্রযুক্তির আরও ব্যবহারযোগ্যতা খুঁজে বের করতে। গুগলের টারা চিপ ইন্টারনেট সংযোগ প্রযুক্তিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। অদৃশ্য আলো ব্যবহার করে সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইট গতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান সত্যিই বিস্ময়কর। যেখানে স্টারলিংক কোটি ডলারের উপগ্রহ নিক্ষেপ করছে, সেখানে গুগল আঙুলের নখের মতো একটি চিপ দিয়ে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়, তবে খুব শিগগিরই টারা হয়ে উঠতে পারে বিশ্বব্যাপী তারহীন ইন্টারনেট বিপ্লবের প্রধান চালিকা শক্তি। সূত্র: লাইভ সায়েন্স, ওয়্যারড