দেশীয় প্রযুক্তিতে মশা দমন, সাফল্যের পথে থিংক ল্যাবস

প্রকাশ: রবিবার, ১১ মে, ২০২৫
https://www.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪ রিপোর্ট
https://www.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হননি, এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া দায়! রাতের ঘুম হারাম, আর দিনের বেলায় ডেঙ্গু বা ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক-এ যেন নিত্যসঙ্গী। কয়েল, স্প্রে, মশারিট-সবই ব্যবহার করি, কিন্তু মশা তাড়ানোটা যেন এক অন্তহীন যুদ্ধ! এই সমস্যার একটু টেকসই আর পরিবেশবান্ধব সমাধান যদি থাকত? ভালো খবর হচ্ছে-বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান "থিংক ল্যাবস" এমনই এক নতুন প্রযুক্তিনির্ভর মশা দমনের যন্ত্র তৈরি করেছে, যা রাসায়নিক নয়, আবার কার্যকারিতাও প্রমাণিত।

মশার মেশিন ছাড়াও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান নিয়ে আরও কিছু যন্ত্র বানায় থিংক ল্যাবস। মাত্র ২০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটিতে এখন পর্যন্ত চার কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত বছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করতে শুরু করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন ৪১ জন কর্মী।

থিংক ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আশিকুর রহমান তানিম। বর্তমানে থিংক ল্যাবসে তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন মালিকানা অংশীদার রয়েছেন। তানিম ২০০৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া যান। পড়ালেখা শেষে সেখানেই কয়েক বছর তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করেন। তবে বাংলাদেশে ফিরে কিছু করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেই চিন্তা থেকেই গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) খাতে বিনিয়োগ নিয়ে ২০১৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘থিংক’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগ দেন একদল তরুণ বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও গবেষক। এই থিংক ল্যাবসেরই নিজস্ব আবিষ্কার ‘মশার মেশিন’। যেটি এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয়েছে।

যেভাবে কাজ করে যন্ত্রটি

আশিকুর তানিম জানান, মূলত নিশ্বাসের মাধ্যমে বের হওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডকে অনুসরণ করে প্রাণীদেহের কাছে পৌঁছায় মশা। এ কারণে থিংক ল্যাবের উদ্ভাবিত মশার মেশিনের একেবারে নিচে একটি ‘ট্র্যাপ’ চেম্বার রয়েছে। তার ঠিক ওপরে বিশেষ প্রলেপ দেওয়া সাকশন ফ্যান (যা বস্তুকণা নিজের দিকে টেনে নেয়) এবং তার ওপরে একটি বিশেষ লাইট ব্যবহার করা হয়েছে। মেশিনটি চালুর পর ফ্যানটি ঘুরতে থাকে। তখন প্রলেপটির সঙ্গে লাইটের আলোর একটি ফটোক্যাটালিটিক প্রক্রিয়া তৈরি হয়, যা মশার জন্য একটি শক্তিশালী ফাঁদ তৈরি করে।

মশা সাধারণত ১০০ মিটারের বেশি দূরত্বে নিজ থেকে উড়তে পারে না। স্ত্রী মশা যখন নির্দিষ্ট দূরত্বে চলে আসে, তখন যন্ত্রটির মাধ্যমে তৈরি হওয়া মানুষের মতো কৃত্রিম নিশ্বাসে আকৃষ্ট হয় ও ফাঁদে আটকা পড়ে। কোনো মশা যন্ত্রটির প্রবেশপথে একবার ঢুকে গেলে সাকশন ফ্যানের কারণে সেগুলো আর বের হতে পারে না এবং সরাসরি ট্র্যাপ চেম্বারে গিয়ে আটকে যায়। সেখানে ডিহাইড্রেড (পানিশূন্যতায়) হয়ে একপর্যায়ে মারা যায়। যন্ত্রটি ভবনের অভ্যন্তরে, প্রবেশদ্বার বা যেকোনো খোলা জায়গায় যেখানে মশার উপস্থিতি বেশি, সেখানে স্থাপন করা যায়।


বর্তমানে ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী, সাভারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও খোলা জায়গায় থিংক ল্যাবসের এই মশা মারার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, কুমিল্লা, কক্সবাজার, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় গ্রাহকেরা যন্ত্রটি কিনে বসিয়েছেন। বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, সেনানিবাস, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঁচ তারকা হোটেলেও মশা নিধনে যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়েছে।

যন্ত্রটি ২৪ ঘণ্টাই চালু রাখতে হয়। তবে এতে বিদ্যুৎ খরচ খুব কম। পুরোপুরি মেটাল কাঠামোতে বানানো যন্ত্রটি ঝড়বৃষ্টিসহ নানা ধরনের ঝুঁকি থেকেও মুক্ত। অত্যধিক ওজনের কারণে কারও পক্ষে এটি চুরি করে নেওয়াও কষ্টকর। তা ছাড়া কিছু মডেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক সেন্সর লাগানো রয়েছে। সব মিলিয়ে এই যন্ত্রটি পাঁচ বছরের বেশি সময় স্থায়ী হবে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে তিনটি আকারে যন্ত্রটি পাওয়া যায়। আকারভেদে দাম ৩১ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মশার মৌসুমের ওপরে নির্ভর করে মাসে গড়ে ৩০টি যন্ত্র বিক্রি হয়। তানিম বলেন, প্রভাব বিবেচনায় ও এককালীন স্থায়ী বিনিয়োগ হিসেবে যন্ত্রটির দাম খুব বেশি নয়। আর আমাদের বিশেষত্ব হচ্ছে-এটির যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি, কর্মী সব দেশীয়। ফলে বলতে পারেন, এটি শতভাগ দেশীয় পণ্য, যা বাংলাদেশিদের জন্যই বানানো।

আরও যেসব কাজ করে থিংক

মূলত গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান তৈরি করে দেয় থিংক ল্যাবস। মশার মেশিন ছাড়াও এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশ কিছু পণ্য তৈরি করেছে তারা। যেমন বেলজিয়ামের একটি কোম্পানির জন্য নয়েস মনিটরিং ডিভাইস তৈরি করেছে থিংক। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য ভ্যাকসিনের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের তারহীন সেন্সর বানিয়েছে তারা। আবার গ্যাসের সরবরাহ লাইনের তদারকি, জেনারেটরের ডিজেল পরিমাপ, হাইড্রোফোনিক উদ্ভিদের স্বয়ংক্রিয় তদারকি প্রভৃতি কাজের জন্য সেন্সর যন্ত্র বানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

আশিকুর তানিম বলেন, ‘আরঅ্যান্ডডি নিয়ে কাজ করতে অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে আমাদের জন্য বিনিয়োগের চেয়েও সরকারের নীতিসহায়তা বেশি প্রয়োজন। দেশীয় প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার বাড়ালে ও আমদানি নিরুৎসাহিত করলে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে।’
image

আপনার মতামত দিন