সমুদ্রজয়ের পথে বাংলাদেশের হাঙর রোবট

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫
https://www.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png নিজস্ব প্রতিবেদক
https://www.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে আছে গ্যাস, খনিজসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ। এই সাগরজয়ই একদিন বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির গতিপথ। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একদল তরুণ শিক্ষার্থী তৈরি করছেন এক বিশেষ ধরনের রোবট-যার নাম ‘হাঙর’।

এই হাঙর কোনো জীবন্ত প্রাণী নয়, এটি একটি পানির নিচে চলাচল করতে সক্ষম আধুনিক রোবট। এটি তৈরি করছে টেক অটোক্র্যাটস-বেঙ্গল সাব নামের একটি শিক্ষার্থী দল। তারা অংশ নিচ্ছে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আন্ডারওয়াটার রোবোটিকস প্রতিযোগিতা রোবোসাব ২০২৫-এ।

 কী এই রোবোসাব প্রতিযোগিতা?
প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় উলেট অ্যাকুয়াটিকস সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় রোবোসাব প্রতিযোগিতা। বিশ্বের নানা প্রান্তের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। এখানে তারা অটোনমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল (AUV) বা স্বয়ংক্রিয় পানির নিচের যান নিয়ে প্রতিযোগিতা করেন।

এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য শুধু রোবট বানানো নয়-এটি শিক্ষার্থীদের সমুদ্রবিজ্ঞান, রোবোটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধানে উৎসাহিত করে।

 বাংলাদেশ থেকে অংশ নিচ্ছে টেক অটোক্র্যাটস-বেঙ্গল সাব
বাংলাদেশের হয়ে অংশ নিচ্ছে ১৫ সদস্যের দল ‘টেক অটোক্র্যাটস-বেঙ্গল সাব’। এই দলে রয়েছে অষ্টম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত বিভিন্ন বয়স ও দক্ষতার সদস্যরা। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও দলনেতা মিরাজ তাসলিম বলেন, “আমরা বিভিন্ন বয়স ও দক্ষতার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দল গঠন করেছি। প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে রোবটটি অনেক ধাপের পরীক্ষা পেরিয়ে গেছে।”

প্রকল্প ব্যবস্থাপক আন নাফিউ জানান, তাদের লক্ষ্য একটি পূর্ণাঙ্গ স্বয়ংক্রিয় রোবট তৈরি করা, যা পানির নিচে নিজে নিজে চলাফেরা ও বিভিন্ন কাজ করতে পারবে।

 হাঙর রোবটের বিশেষত্ব কী?
দলটি তাদের রোবটের নাম দিয়েছে ‘হাঙর’। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন রোবোসাব প্রতিযোগিতার ছয়টি ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করতে পারে। রোবটটি নিচের কাজগুলো করতে সক্ষম-

>>পানির নিচে চলতে চলতে নিজেই গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারবে

>>লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারবে

>>নির্দিষ্ট বস্তু পরিবহন করতে পারবে

>>নির্ধারিত ফ্রেমের ভেতর দিয়ে সাঁতরে যেতে পারবে

দলের সদস্য রুবাইয়াত এইচ রহমান বলেন, “রোবটটি আমরা এমনভাবে তৈরি করেছি, যেন এটি শুধু সুইমিংপুলে নয়, খোলা সমুদ্রেও কাজ করতে পারে। আগামী মাসে আমরা সেন্ট মার্টিনে গিয়ে এর ফিল্ড টেস্ট করব।”

 শুধু প্রতিযোগিতা নয়, ভবিষ্যতের জন্য প্রযুক্তি
দলটির কনিষ্ঠ সদস্য এ কে এম ফাইয়াজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে বলছে, “এই রোবট শুধু প্রতিযোগিতার জন্য নয়। আমরা চাই এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্র গবেষণায় ব্যবহৃত হোক। দূষণ শনাক্ত, উদ্ধারকাজ বা খনিজ অনুসন্ধানে রোবটটি ব্যবহার করা সম্ভব।”

রোবটটিতে যুক্ত হচ্ছে ক্যামেরা ও সেন্সর-যা পানির নিচ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দূষিত এলাকার ম্যাপ তৈরি করতে পারবে।

 দলীয় কাজ শেখাচ্ছে নেতৃত্ব ও সমস্যা সমাধান
দলের উপদেষ্টা রাসেল আহমেদ বলেন,  “এই প্রকল্প শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়িয়েছে। কেউ ইলেকট্রনিকস, কেউ কোডিং, কেউ মেকানিক্যাল ডিজাইন নিয়ে কাজ করছে। তারা একে অন্যের দক্ষতাকে সম্মান করতে শিখছে।”

দলের সবচেয়ে ছোট সদস্য আহনাফ সাফওয়ান ইসলাম (অষ্টম শ্রেণি) বলেছে, “আমি মেকানিক্যাল ডিজাইন, থ্রিডি মডেলিং ও গবেষণাপত্রে কাজ করছি। পরীক্ষার সময় উপস্থিত থেকে ত্রুটি ধরার চেষ্টা করি।”

 প্রযুক্তি, শিক্ষা ও স্বপ্নের সমন্বয়
রোবট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে:

>> বিভিন্ন ধরনের সেন্সর
>>পাইথনের মতো প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ
>>কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদম

এই প্রতিযোগিতা শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয়, আন্তর্জাতিক পরিবেশে নিজেকে উপস্থাপন করার বড় সুযোগও।

বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান যেমন, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সেই মঞ্চেই এবার বাংলাদেশের পতাকা ও সম্ভাবনা তুলে ধরবে আমাদের ‘হাঙর’।

 সরকারের সহায়তা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
দলের কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভ্রমণ খরচের একটি অংশ বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগের রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন গ্র্যান্ট থেকে প্রদান করা হয়েছে। এটি তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা।

দলের সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত আছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক গোলাম কাদের।

‘হাঙর’ শুধু একটি রোবট নয়, এটি তরুণদের স্বপ্ন, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সমুদ্রজয়ের প্রতীক। টেক অটোক্র্যাটস–বেঙ্গল সাব দলের এই যাত্রা হয়তো একদিন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ উদ্ভাবকদের জন্য।

image

আপনার মতামত দিন