বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তে পা রাখছে মানব সভ্যতা। মানুষের জীবনের মৌলিক উপাদান ডিএনএ এখন আর শুধু প্রকৃতির সৃষ্টি নয়-মানবহাতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ডিএনএ তৈরির প্রকল্প শুরু হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এটি হতে পারে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। যদিও এ নিয়ে উদ্বেগ, বিতর্ক ও প্রশ্নের শেষ নেই।
ডিএনএ কৃত্রিমভাবে তৈরি-কেন এই গবেষণা?
ব্রিটেনের বৃহত্তম চিকিৎসা দাতব্য সংস্থা ওয়েলকাম ট্রাস্ট এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ১০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে। তাদের মতে, এই গবেষণা বহু দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এনে দিতে পারে। অতীতে এই ধরনের গবেষণা নৈতিক ও জৈবিক প্রশ্নে নিষিদ্ধ ছিল, তবে এখন অনেকটাই উন্মুক্ত হচ্ছে।
ড. জুলিয়ান সেল, যিনি কেমব্রিজের এমআরসি ল্যাবরেটরি অব মলিকিউলার বায়োলজির গবেষক, এই প্রকল্পকে জীববিজ্ঞানের ‘পরবর্তী ধাপের বিশাল পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন। তার ভাষায়, “আমরা এমন থেরাপির কথা ভাবছি যা মানুষের বার্ধক্যকে সুস্থ করে তুলবে এবং দেহের অঙ্গগুলো পুনরুজ্জীবিত করবে।”
কেমন হতে পারে এই প্রযুক্তির সুফল?
>> রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো
>> ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ যেমন লিভার, হার্ট, ইমিউন সিস্টেম পুনরায় কার্যকর করা
>> জিনগত সমস্যাজনিত রোগের লক্ষণ পূর্বাভাস ও প্রতিরোধ।
>> বয়সজনিত রোগে চিকিৎসার নতুন সম্ভাবনা
এই লক্ষ্যেই শুরু হয়েছে Synthetic Human Genome Project, যেখানে কেবল ডিএনএ পড়া নয়, ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশ কৃত্রিমভাবে তৈরি করার প্রযুক্তিও উন্নয়ন করা হচ্ছে। একে বলা হচ্ছে মানব জিনোম গবেষণার পরবর্তী ধাপ।
কিন্তু উদ্বেগ কীসের?
বিজ্ঞানের সম্ভাবনার সঙ্গে চলে আসে নৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি। গবেষণার সমর্থকরা আশা দেখালেও, সমালোচকরা এই উদ্যোগকে বলছেন-"প্যান্ডোরার বাক্স" খুলে ফেলার মতো একটি কাজ।
ড. প্যাট থমাস, 'Beyond GM' নামের একটি প্রচার সংগঠনের পরিচালক, সতর্ক করে বলেছেন, “সব বিজ্ঞানী ভালো উদ্দেশ্যে কাজ করছেন তা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। প্রযুক্তিকে যেভাবে ভালো কাজে লাগানো যায়, তেমনভাবেই খারাপ উদ্দেশ্যেও ব্যবহার হতে পারে।”
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্বের বিজ্ঞানী প্রফেসর বিল আর্নশ কৃত্রিম মানব ক্রোমোজোম তৈরির একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন। তার মতে, বিজ্ঞানীরা জৈবিক অস্ত্র, উন্নত মানুষ, এমনকি মানব ডিএনএ সহ প্রাণী তৈরির চেষ্টা করতে পারে।
তিনি বিবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমরা এখন কিছু বিধিনিষেধ রাখতে পারি। কিন্তু যদি কোনো সংস্থা উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অ্যাক্সেস পেয়ে কিছু তৈরি করা শুরু করে, তবে আমি মনে করি না আমরা তাদের থামাতে পারব।’
গবেষণা কতটা নিরাপদ?
বর্তমানে গবেষণাটি সীমাবদ্ধ থাকবে পরীক্ষাগারের টেস্টটিউব ও ডিশে। প্রকৃত কৃত্রিম জীবন তৈরির কোনো উদ্যোগ এই প্রকল্পের মধ্যে নেই। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে সুশাসন, আন্তর্জাতিক নীতিমালা এবং নৈতিক তদারকি গুরুত্বপূর্ণ।
মানবতার ইতিহাসে প্রযুক্তি যেমন মুক্তি দিয়েছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে দ্বিধা। কৃত্রিম ডিএনএ তৈরির প্রকল্প একদিকে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞানে আশার আলো জাগায়, অন্যদিকে এটি খুলে দিতে পারে এমন এক দরজা-যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর হতে পারে। তাই এখনই দরকার খোলামেলা বিতর্ক, বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ এবং নৈতিক নীতিমালা প্রতিষ্ঠা। সূত্র: বিবিসি